গতি ফিরছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, তবুও উদ্বিগ্ন গার্মেন্টস মালিকরা

আপডেট: জুলাই ২৮, ২০২৪, ১২:৩৯ অপরাহ্ণ


সোনার দেশ ডেস্ক :


কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরতে শুরু করেছে। ব্যাংক-বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেন বেড়েছে। ধীরে ধীরে লেনদেনের সময়সীমাও বাড়ানো হচ্ছে।

কারফিউ শিথিল হওয়ার পর থেকে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে তৈরি পোশাক শিল্পে। অন্যান্য শিল্পকারখানাও এরইমধ্যে চালু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও চালু হয়েছে পুরোদমে। শুরু হয়েছে পণ্য রফতানি। আমদানি পণ্য খালাসেও বেড়েছে গতি।

তবে ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। দিনের বেলায় ৭-৮ ঘণ্টা ছাড়া অন্য সময় কারফিউ বলবৎ থাকার পাশাপাশি সীমিত ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের কারণে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিসহ টানা পাঁচ দিন ব্যাংক বন্ধ থাকার পর দুই দিন (বুধ ও বৃহস্পতিবার) চার ঘণ্টা করে ব্যাংকের সীমিতসংখ্যক শাখা খোলা ছিল। এ সময় টাকা জমা দেওয়া ও তোলা ছাড়া ব্যাংকে অন্য কার্যক্রম তেমন একটা ছিল না। অনেকেই চেষ্টা করেও এলসি খুলতে পারেননি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে দেশের শীর্ষ রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের চট্টগ্রামের কিছু কারখানা চালু থাকলেও দেশের বেশিরভাগ কারখানা ছিল বন্ধ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সহিংসতার কারণে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

এতে সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকিং কার্যক্রম। ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধের পর ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করা হলে দেশের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২৩ জুলাই থেকে চট্টগ্রামের শিল্পকারখানা খোলার অনুমতি দেয় সরকার।

পরদিন ২৪ জুলাই ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহের ভালুকাসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় উৎপাদন শুরু হয়। একইদিনে সীমিত আকারে ব্যাংকগুলোতে লেনদেনের পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ দেওয়া হয়।

এতে রফতানিকারকদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এলেও সর্বোপরি ব্যবসায়ী মহলে এখনও উদ্বেগ বিরাজ করছে। কারখানা বন্ধ থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের ‘ইমেজ নষ্ট’ করার জের কতদিন টানতে হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কয়েক হাজার গার্মেন্টস কারখানার মালিক।

ইন্টারনেট-সেবা ব্যাহত হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে অর্ডার (ক্রয়াদেশ) ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সাধারণত ডিসেম্বরের দিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে ছুটি ও ভ্রমণের আমেজ থাকায়— তখন বাংলাদেশের রফতানি পণ্য ভালো বিক্রি হয়।

ওই সময়ের অর্ডার (ক্রয়াদেশ) পেতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম নমুনা পাঠাচ্ছে ক্রেতা দেশগুলোতে। এ ক্ষেত্রে গত কয়েকদিনের স্থবিরতায় বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট-সেবা না থাকায় অনেকেই নমুনা পাঠাতে সমস্যায় পড়েছেন বা পিছিয়ে পড়েছেন।

অনেকেই বলছেন, ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের ‘আস্থার’ যে সংকট হয়েছে, তার মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশকে। এর জেরে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ২০ শতাংশ রফতানি কমে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

বিজিএমইএ’র একাধিক সদস্য বলেছেন, অনেক ক্রেতা আছেন— যারা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই নিজ দেশে বসে দেখেন ও জানতে পারেন। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা এখন আস্থা পাচ্ছেন না।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি এসএম মান্নান কচি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গার্মেন্টস কারখানা চালু করা সম্ভব হয়েছে। এতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কিন্তু আমাদের প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ও নির্ভরতায় ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার ফলে আমাদের ভাবমূর্তির যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা টাকার অঙ্কে প্রকাশ করা কঠিন। এই সুনামের ক্ষতি হয়তো আমাদের বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে। এর রেশ কাটতে কতদিন সময় লাগবে, তা কেউ বলতে পারবে না।’

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এরইমধ্যে সব কারখানা চালু করা হয়েছে। উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার কারখানা খোলা রাখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘উৎপাদন স্বাভাবিক হলেও নতুন করে অর্ডার করছেন না বিদেশি ক্রেতারা।

বাংলাদেশ এখন ইমেজ সংকটে পড়েছে। এতে আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। এখন তারা বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।’ মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, অচিরেই এই সমস্যা কেটে যাবে।

চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (সিইপিজেডে) প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের ৯টি তৈরি পোশাক কারখানা গত বুধবার (২৪ জুলাই) চালু হয়েছে। কোম্পানিটির একজন শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, কারফিউ’র কারণে গত চার দিন কাজ না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উৎপাদন পিছিয়ে পড়েছে, এখন সেই জট স্বাভাবিক করতে কম করে দুই মাস লাগবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি করে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে (২০২৪) পর্যন্ত বাংলাদেশ আয় করেছে ৩৩ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার।

ইপিবি (রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো) তাদের প্রকাশিত তথ্যে দেখিয়েছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে তৈরি পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৪৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছরের (২০২২-২৩) একই সময়ে ছিল ৪২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

ইপিবির হিসাবে বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি থেকে আয় করে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পোশাক রফতানি থেকে আসে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ কয়েকদিনের স্থবিরতায় সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সবচেয়ে বড় এই খাতেই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারফিউ শিথিল ও ইন্টারনেট ফেরার পর উৎপাদন স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও পরিস্থিতি আগের মতো হতে দুই-তিন মাস সময় লেগে যেতে পারে।

এদিকে কারফিউ জারির প্রথম চার দিন বন্ধ থাকার পর গত বুধবার (২৪ জুলাই) থেকে রাজধানীর দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও ক্রেতাদের উপস্থিতি খুবই কম। বেচাবিক্রিও করতে পারছে না অনেকে। এমনকি রাজধানীর শপিংমলগুলোতেও দেখা যাচ্ছে না ক্রেতাদের আনাগোনা। ফলে ব্যবসায়ীদের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে।

রাজধানীর কয়েকটি বিপণি বিতানের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে ১৪-১৫ দিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে না। তাতে মাস শেষে অনেকের দোকানের ভাড়া ও কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হবে। বিক্রেতারা বলছেন, সাধারণত বিকালের দিকে শপিংমলে ক্রেতা বেশি আসেন, আর এ সময় এখনও কারফিউ চলছে, তাই শপিংমলে ক্রেতা খুবই কমে গেছে।
-বাংলা ট্রিবিউন

Exit mobile version