গন্তব্যে ফেরার তাড়া

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ


সাজিদ রহমান:


মূল হাইওয়ে থেকে বামের একটা সড়কে ঢুকে পড়ে গাড়িটা। সচরাচর জার্নিতে একদম ঘুম আসে না। বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটা ঝিমুনির ভাব আসে। গাড়িটা দুলতে থাকলে ঝিমুনি ভাবটা কমে আসে। চোখ খুলে বুঝতে পারি, সড়কটা মূলত বাঁধের ওপর তৈরি। ছররা গুলি ছুঁড়লে মানুষের শরীর ফুটো হয়ে ছোট-বড় গর্ত হয়ে যায়। সেই গর্ত দিয়ে কখনো কখনো শরীরের ভেতরের প্যাঁচানো নাড়িভুঁড়ি, বেঁকে যাওয়া হাড্ডি, সদ্য ফুটো হওয়া হৃৎপিণ্ডও দেখা যায়। সড়কের অবস্থা দেখে সে রকমই লাগছে। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে সড়কটিতে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অনেক গর্ত। সেটা ধরে আমাদের গাড়িটা আরও সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। রাস্তার পাশেই একটা পাকুড়গাছ। যেন কোনো এক প্রেয়সীর অপেক্ষায় একজন উঁচু-লম্বা পুরুষ মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে। আর তার দোরগোড়ায় রেখে দিয়েছে সুন্দর বসার আয়োজন। সেখানে কয়েকজন ষাটোর্ধ্ব ছোকরাকে গালগল্পে মশগুল থাকতে দেখা যায়। আমাদের ফেরার তাড়া ছিল এবং তখনো বুঝে আসেনি যে আমরা ভুল পথে ঢুকে পড়েছি। এদিকটায় রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ। নদীতে বড় ঢেউয়ের তালে নৌকা যেমন দোলে, চলার সময় আমাদের সাদা গাড়িটাও অমন উথাল-পাতাল দুলতে থাকে। আমাদের জীবনটাও ঢেউয়ের তালে চলা নৌকার মতো। জীবনের বাঁকে বাঁকে আমাদের জীবননৌকাও জোয়ার-ভাটার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায়। দেখতে দেখতেই ঘরঘরঘর শব্দ করে গাড়িটা পাকুড়গাছের পাশে পাকুড়গাছের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ে।

মুহূর্তেই ঝিমুনি ভাব উধাও হয়ে যায়, বিরক্তি এসে সে জায়গাটা দখল নেয়। ড্রাইভার খুব সিরিয়াস হয়ে গাড়ির বনেট খোলে। একবার ব্যাটারির কানেকশন চেক করে, আরেকবার রেডিয়টরে পানি আছে কি না, সেটা পরখ করতে থাকে। কিংবা এমন হতে পারে, বকা খাওয়ার ভয়ে সে তখন পেশাদার অভিনেতার মতো অভিনয় করতে থাকে। তবে সত্য হলো, তার মতো ও রকম অভিনয় আমরা সবাই করে থাকি। তবে যখন নিজেরা করি, তখন ভাবি, অভিনয়টা কেউ বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভাবি, হয়তো নিয়তি আমাদের এখানে দাঁড় করিয়েছে। আচ্ছা, নিয়তি ও সময় কি ভিন্ন কিছু? নিয়তি তো সময়ের ওপর এসে ভর করে। আবার যেমন, সময় খারাপ গেলে তাকে নিয়তির খেল বলি। ড্রাইভারের মঞ্চনাটক না দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে, গাছের পাতার দুলুনিতে সেটা বেশ বোঝা যায়। সে
বাতাসের স্পর্শে শরীরটা বেশ আরাম বোধ করে, মনেও পুলক ভাব আসে। তখনই পাকুড়গাছের আরেক পাশে বাঁশের মাচান চোখে পড়ে। কয়েক কদম ফেলে সেখানে গিয়ে বসি। স্নিগ্ধ বাতাসের আলিঙ্গনে চোখে ঘুমের ভাব চলে আসে। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে চারপাশটা খেয়াল করতে থাকি। পাশে বয়ে চলা একটা নদী চোখে পড়ে। এ সময় নদীতে পানি কম। নদীর দু’ধারের চরে অনেক চাষিভাই কাজ করছেন। কেউ বাদাম, কেউবা তরমুজের খেতে। হয়তো আগের দিনে এ চরগুলো নদী ছিল। ছিল দুকূল উপচানো
জলরাশি। সেই জলের তরঙ্গে পাল তুলে দিয়ে ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে এগিয়ে চলছে মাঝির দল। হয়তো নৌকা বোঝাই থাকত পাট কিংবা অন্য কোনো ফসল। গঞ্জের আড়তদারের হাতে পৌঁছে দিতে পারলেই আসবে এক কাঁড়ি টাকা। বাজার-সদাই কিনে আবার ফিরবে নিজ গাঁয়ে। এখন এ দৃশ্য কল্পনাতেও আসে না। উজানে ভিনদেশি বাঁধের লৌহকপাট আর দেশে অপরিকল্পিত উন্নয়নের অত্যাচারে নদীর দশা প্রাইভেট ক্লিনিকের আইসিইউতে থাকা মুমূর্ষু রোগীর মতো, যেখানে নদী কিংবা মানুষের জীবন দুটোরই ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় ব্যবসায়িক লাভ- লোকসানের নিখুঁত হিসাবে।

একটা নদীর নাম কে দেয়? কীভাবে সে নামটা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে? কবিরা কি এখনো নদী নিয়ে কবিতা লেখেন? কী লেখেন? জলভরা নদী অনেকটা যৌবনবতী নারীর মতো? এমনকি মরা নদীতেও কবিরা শুধু নারীর প্রেমই দেখতে পান? নাকি কেউ কেউ নদী। ও নদীর পাড়ের হাজারো মানুষের দুর্দশার কথা ভেবে ঘুমহীন রাত পার করেন ? যেভাবেই আসুক, নদীকে অস্বীকার করার সুযোগ কি কখনো থাকে? কেননা, নীল নদ, দজলা-ফোরাত, গঙ্গা, মিসিসিপি, আমাজনের তীরে বেড়ে উঠেছেন আমাদের আদি পিতা-মাতারা। এ রকম উদ্ভট চিন্তা কেন মাথায় আসে, তাও ভেবে পাই না। নিজেকে নিজেই ঝাঁকুনি দিই। দামুদিয়া। নদীর এ নামটা জেনে একধরনের মায়ায় পড়ে যাই। আশা আর মায়া মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে আজীবন। মানুষকে অন্য প্রাণিকুল থেকে আলাদা করেছে। সেই মায়ার শিকড় যেন বেশি দূর
না যায়, সেটা নিয়ে সতর্ক থাকতে চেয়েও পারি না। মাচানে বসে আবারও সে ক্ষতবিক্ষত রাস্তাটা দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু এবার নজরে আসে সে পথ দিয়ে হেঁটে আসতে থাকা একজন বয়স্থ মানুষ। তিনি আমাদের গাড়িটার সামনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে গাছতলার একদম কাছাকাছি চলে আসেন।

বয়স্ক সেই চাচার পরনে একটা লুঙ্গি, যার অর্ধেকটা ভেজা। ওপরে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি। সেটাতেও ছোপ
ছোপ দাগ। তবে চওড়া হাসি সারা মুখমণ্ডলে বিরাজ করছে। মুখে একটা বিড়ি ধরানো। সেটা ঠোঁটে রেখেই টানছেন। যুগপৎভাবে নাক দিয়ে ধোঁয়াও ছাড়ছেন। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, বিড়ি ঠোঁটে রেখেই বিশেষ কৌশলে কথাও বলছেন। হঠাৎ মনে হয়, আমি গব্বর সিংয়ের সামনে বেয়াদবের মতো বসে আছি। এখনই হয়তো বলে বসবে, এ শহরে বাবু ইধার কেয়া মাংতা হায় ? তবে আমার ভাগ্য ভালো, ও রকম কোনো কিছু ঘটে না।
চাচার দিকে ভালো করে খেয়াল করি। চাচার পাড়ে বাঁশের বাঙ্গুয়ার এক পাশে মাছ ধরা একটা জাল, অন্য পাশে বেশ বড় একটা বোয়াল মাছ ঝোলানো। বোয়ালটা তখনো লাফাচ্ছে। এবার বুঝে আসে চাচার চওড়া হাসির কারণ। সুখটান দিয়ে বিড়ি খাওয়ার কারণও তখন অজানা থাকে না। নদীতে পানি কম। কম পানির নদীতে প্রতিদিন এ রকম বড় বোয়াল জালে এসে ধরা দেয় না। সারা বিকেল জাল ফেলে কখনো কখনো দু’চারটা টাকি, ট্যাংরা, পোয়া মাছ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ওই নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। আজকে চাচার রাজকপাল। কল্পনা করি, বোয়ালটা ধরার পর অন্যরা এসে হয়তো চাচার কপালে কপাল ঘষতে চেয়েছেন। চাচা আজ যেন নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট। যেন নতুন একটা রাজ্য জয় করে ফেলেছেন। চাচা জাল গুটিয়ে চওড়া হাসিমুখ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছেন। ঠিক অমন সময় চাচা ও তার চওড়া হাসি নজরে পড়ে আমার।
ড্রাইভার জানায়, গাড়ি স্টার্ট হয়েছে। তখন আমার মনে পড়ে, আমাদের ফেরার তাড়া ছিল। খুব দ্রুত গন্তব্যে ফিরতে হবে। তার ওপর আমরা আছি ভুল পথে। ওদিকে জীবন্ত বোয়াল দেখে সেটারও লোভ পেয়ে বসে। চাচাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি সেটা বেঁচবেন কি না? ‘অনেক দিন ধরে হামাগের নাতি কোনা বোয়াল থাবা চাছিল।’ চাচা বিড়বিড় করে বললেও কথাটা আমার কানে আসে। বিড়িতে একটা লম্বা টান দেয়, এরপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দুদণ্ড ভাবে। হ্যাঁ, বোয়ালটা বেচবেন তিনি। গাড়ির ড্রাইভার ফের মনে করে দেয় গন্তব্যে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা। পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট চাচার হাতে ধরিয়ে দিই। চাচার ঠোঁটের বিড়িটা তখনো শেষ হয়নি। বিড়ি ঠোঁটে রেখেই চওড়া একটা হাসি দেন। ড্রাইভার বোয়ালটা গাড়ির ব্যাক ডালায় চালান দিয়ে দেয়।

গাড়ি ছেড়ে দিলে পেছনে তাকাই। চাচার হাতে টাকা। কিন্তু বেশ অন্যমনস্ক লাগছিল। বিড়িমুখের চওড়া হাসিটা নিতে আসছে। চাচা হয়তো আবারও বিড়বিড় করছেন, ‘অনেক দিন ধরে হামাগের নাতি কোনা বোয়াল খাবা চাছিল।’ কাগজের নোটের কাছে হেরে যায় নাতির বোয়াল খাওয়ার খায়েশ ।
এসব ভাবনার জালের মায়া ছিন্ন করতে চাই। ড্রাইভারকে বলি, হাতে একদম সময় নেই। আরও জোরসে চলো। কারণ আমার গন্তব্যে ফেরার তাড়া ছিল।