মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
আবুল কালাম আজাদ:
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের দাপটে থামছে না ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর খননের মহাযজ্ঞ। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিন ফসলি কৃষি জমির ক্ষতি করে অবৈধ পুকুর খননের ফলে দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে কৃষি জমি। তারপরও কৃষক, জনগণ, প্রশাসন, পরিবেশবাদিদের থোড়াই তোয়াক্কা করে দাপটের সাথে পুকুর খনন চলছে তো চলছেই…।
দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি জমি।
পুকুর খনন বন্ধ না করা হলে স্থায়ী জলাবদ্ধতাসহ কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা। এছাড়াও সড়ক-মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে চলছে মাটি বহণকারী ট্রাক্টর। এর ফলে যেমন কৃষি জমি কমছে, তেমনি পাকা রাস্তা গুলো দ্রুত সময়ের মধ্যেই চলাচলের অনুপোযগি হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখাযায়, উপজেলার হাড়িভাঙ্গা বিল, হাজিরহাট, চাপিলা, বিয়াঘাট, ধারাবারিষা, নাজিরপুর মশিন্দা মাঠসহ প্রায় ১০টি মাঠে এক্সভেটর মেশিন দিয়ে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রের ব্যক্তিরা।
২০১৯ সালের ১২ মে ঢাকাস্থ ‘লইয়ারস সোসাইটি ফর ল’ নামক একটি মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষে মহাসচিব এড. মেজবাহুল ইসলাম আতিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালত নাটোর জেলার নাটোর সদর, নলডাঙ্গা, সিংড়া, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলার নাম উল্লেখ করে কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে নির্দেশ দেন। তবে আদালতের নির্দেশ কাগজে কলমে বাস্তবায়ন হলেও প্রতি বছর দুই-তিন ফসলি জমি পুকুর খনন করলেও এসব পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসন কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় কৃষকদের। তবে পুকুর খননকারী মাটি ব্যবসায়ীদের দাবি উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়েই এসব পুকুর খনন করা হচ্ছে।
উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের কাছিকাটা মাঠে দেখাযায় মশিন্দা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহাবুব হাসান লাবু তার নিজের ৬ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন। একই জায়গায় রুহুল ও রফিক নামের দুই ব্যবসায়ী ৫ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে পাকা রাস্তা নষ্ঠ করে বিভিন্ন জায়গায় মাটি বিক্রি করছে। হাজিরহাট এলাকায় মহাসড়কের পাশেই আব্দুল আজিজ ১০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে মহাসড়ক দিয়ে মাটি বিক্রি করছেন। এছাড়াও হাড়ি ভাঙ্গা বিলে শাহাদৎ হোসেন রান্টু, সানোয়ার হোসেন, কৃষি জমি নষ্ঠ করে পুকুর খনন করছে। চাপিলা ইউনিয়নের ধানুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেই খনন করা হচ্ছে পুকুর। ফলে বিদ্যালয়ে শব্দ দূষণসহ ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন বিল্ডিং ধসে পড়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুকুর খননের ফলে উপজেলা জুড়ে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ১ হাজার ১৫১ হেক্টর। ২০১৮ সালেও উপজেলা জুড়ে ফসলি জমির পরিমাণ ছিলো ১৫ হাজার ৮১৪ হেক্টর। ২০২২ সালে যেটা দাড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৬৩ হেক্টরে। এছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারী মাসের এই ১৯ দিনেও প্রায় ২৫০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে কমেছে, ১৩৪ হেক্টর,২০১৯,২০২০,২০২১ ও ২০২২ মিলে চার বছরে কমেছে ১ হাজার ১৭ হেক্টর।
উপজেলা মতস্য দপ্তরের জরিপে উঠে এসেছে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ ইউনিয়নে ( পৌরসভা বাদে) ৭ হাজার পুকুর গিলে খেয়েছে ২ হাজার হেক্টর (১৫ হাজার বিঘা) ফসলি জমি। এর৪ মধ্যে- নাজিরপুরে ১হাজার ৪৫০ টি পুকুরের পেটে ৪১৪ হেক্টর ( ৩,১০৫ বিঘা), বিয়াঘাট ইউনিয়নে ৪৯১ টি পুকুরের পেটে ১৩৭ হেক্টর( ১,০২৮ বিঘা), খুবজিপুর ইউনিয়নে ১৪৬ টি পুকুরের পেটে ৪৪ হেক্টর ( ৩৩০ বিঘা ), মশিন্দা ইউনিয়নে ৩৫৪ পুকুরের পেটে ১১২ হেক্টর ( ৮৪০ বিঘা), ধারাবারিষা ইউনিয়নে ৬৩২ পুকুরের পেটে ১৯৪ হেক্টর ( ১,৪৫৫ বিঘা ), এবং চাপিলা ইউনিয়নে ৩,৮৭৫ টি পুকুরের পেটে ১হাজার ১২ হেক্টর ( ৭,৫৯০ বিঘা)। উপজেলা জুড়ে এখন পর্যন্ত বেসরকারি হিসাবে প্রায় ১০ হাজারের উপড়ে পুকুর রয়েছে এবং প্রায় ৩ হাজার হেক্টর (২৩ হাজার বিঘা) ফসলি জমি নির্মমভাবে পুকুরের পেটে বিলীন হয়ে গেছে।
এ দিকে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, গুরুদাসপুর উপজেলা জুড়ে মোট মাছের উৎপাদন ১০৩১৩.১৯ মে.টন। চাহিদার চেয়ে ৪৫৪২.৯৯ মে.টন মাছ বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ৫৭৭০.৩ মে.টন চাহিদা থাকলেও উদ্বৃত্ত হচ্ছে ৪৫৪২.৯৯ মে.টন।
হাজিরহাট এলাকার কৃষক নবীর উদ্দিন জানান, আমাদের এই মাঠে সারা বছর বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ হয়। বিনাহালে রসূনের চাষ এই মাঠ থেকেই আদিকাল থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিরা তিন ফসলি জমি নষ্ঠ করে পুকুর খনন করছে। সেই সাথে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাস্তা অবৈধ মাটি বহণকারী ট্রাক্টর দিয়ে নষ্ট করছে। মহাসড়ক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলাচল করে। যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে প্রশাসন তেমন নজরদারি করছে না। প্রতিবছর এই মাটি বহণকারী ট্রাক্টরের দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে কেউ মারা যায় আর না হয় কেউ গুরুত্বর আহত হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনর রশিদ জানান, দিনের পর দিন ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন করার কারণে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এতে কৃষির ওপর বিরুপ প্রভাব পরবে।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনর রশিদ জানান, দিনের পর দিন ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন করার কারণে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এতে কৃষির ওপর বিরুপ প্রভাব পরবে। কৃষি জমির শ্রেনি পরিবর্তন করে পুকুর খনন বন্ধ করার আমাদের কোন আইনগত ক্ষমতা নাই। তবে কৃষি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন না করতে কৃষকদেরকে সচেতনামূলক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শ্রাবণী রায় জানান, কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে।