রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
ডিএম রাশেদ, পোরশা:
শীতের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহুর্ত হল শীতের সকাল। এটি বাঙালী জীবনে ফেলে এক নিদারুণ বৈচিত্র্যময় প্রভাব। আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাব আনুসারে ছয় ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। যদিও ছয় ঋতু, তার মধ্যে হেমন্ত, শরৎ ও বসস্তের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে পড়ে না। তারতম্য রয়েছে ঋতু ভেদেও। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত এই তিনটিই বাংলাদেশের ঋতুতে প্রধান ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের ঋতুতে অন্য পাঁচটি ঋতুর তুলনায় শীতের প্রভাব ও বৈশিষ্ট জনজীবনে একদম ভিন্নতর। কনকনে হিমেল হাওয়া আর ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে আগমন করে শীতকাল।
শিশির ভেজা প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ মাঠে হলুদ সরষে ফুল, দুই ধারে জমে থাকা শিশির ঝলমল, কুয়াশাচ্ছন্ন ঘাসের পাতা সূর্যোলোকে হীরকের মত ঝিকিমিকি ঝল-জলানি। এমন দৃশ্যে অনায়েসে এসে যায় কবিতা দু’লাইনের মালা- ‘সকালে সোনার রবি করে ঝিকমিক/ সবুজ ঘাসের পাতায় শিশির কণা করে চিকচিক’।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শীতকালের গ্রাম বাংলার ছবি। কুয়াশাঘন আবছা প্রান্তরে সীমিত দৃষ্টি। বাড়ির উঠোনের কোণে খড়, গাছের পাতা ও ধানের চিটায় গনগনে জলন্ত উনুন। আগুনের আঁচে উনুনের ধার ঘেঁষে বসে থাকে ছেলে-বুড়ো সকলে। এই যেন সৃষ্টিকর্তার এক অমূল্য উপহার।
সকাল হলেই শীতের কম্বল গায়ে রাখাল বালক ছুটে চলে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে নাঙা পায়ে। হেমন্তের শেষের দিকে উত্তরে কনকনে হাওয়ার ঠান্ডা আমেজ থেকেই শীতের আগমনিবার্তা প্রকাশ পায়, কিছুটা শীত অনুভূত হয়। হেমন্তের ফসল উঠে যাওয়ার পর প্রকৃতিতে যে শূন্যতা বিরাজ করে, তার মাঝেই শীতের অবস্থান। পৌষ এবং মাঘ এই দু’মাসকে শীতের মাস বলা হয়।
গাছির নামানো খেজুর রস আর গুড়ের মিষ্টি গন্ধে মন কাড়ে। গ্রাম বাংলার খেজুরের পায়েস যার মুখে পড়েছে সে হয়তো আজো না ভুলার কথা, কারো মাঝে খুঁজে বেড়ায় আবার এই স্বাদ না পাওয়ার তিক্ততা। খেজুর রস, টাটকা শাক-সবজি ও রকমারি পিঠায় গ্রামীণ জীবন হয়ে উঠে উপভোগ্য। ঢেঁকির তলে আতপচাল অপনমনে গুনগুনিয়ে খেঁজুর রসে সিক্ত মুখে। ধুম পড়ে যায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সে ভাপা পিঠা খাওয়ার। বাংলা বালার হাতের সুনিপুণ পটুতায় ঢাকনা ঢাকা হাঁড়ির উপরে একরতি কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে মোড়ানো উঠছে আতপচালের গুড়ো ঢাকা, নতুন খেঁজুর গুড় আর নারিকেল দেয়া ছোট বাটি। নামছে এক একটা ভাপা পিঠা। এ যেন পরম আদর, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসার এবং পারিবারিক অটুট বাঁধনের এক চিরায়িত গ্রাম বাংলার চিরচেনা শীতকালীন ছবি।
এসময় আরো শীতকালীন অনেক পিঠা তৈরী করে থাকে গ্রামের মানুষ এগুলোর মধ্যে চিতই, দুধচিতই, বড়াপিঠা, পাটিসাপটা, দুধপুলি, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি প্রভৃতি পিঠার বেশ প্রচলন রয়েছে।
হিমেল হাওয়ার টানে শুষ্ক শীতল চেহারার আবরণ নিয়ে আসে শীতঋতু। দারুণ রুক্ষতা, পরিপƒর্ণ রিক্ততা ও বিষাদের এক প্রতিমূর্তি শীতঋতু। ছেলে মেয়েরা অপেক্ষায় থাকে শীতের সকালের সবচেযে কাঙ্খিত জিনিস কখন সূর্য উঠবে আর তার তীর্থক রোদের স্পর্শের।
শীতকাল কৃষকদের এবং তাদের ফসল চাষাবাদের জন্য সুন্দর এক অনুকূলীয় পরিবেশ। রবিশস্যের প্রাচূর্য্যে পূর্ণ হয়ে উঠে শুকনো মাঠ। ভরে উঠে টাটকা শাক-সবজি। লালশাক, মিষ্টি আলু, নতুন আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, মূলা, বেগুন, শালগমসহ বিভিন্ন প্রকারের ডাল ইত্যাদিতে মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। তবে শীতকালে শৈত্য প্রবাহ মাঝে মাঝে ফসলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠে।
এমন সৌন্দর্যকে আরো অপরূপ লীলায় লালিত করতে যেন যোগ দেয় শীতকালীন রং বেরঙের বাহারি গোলাপ, গাঁধা, অতসী, সূর্যমুখী, জুঁই, চামেলী, বেলী, রজনীগন্ধ্যা আর বকুলের টানে। বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার গন্ধে রঞ্জিত হয় চৌতুর দিকের অবহাওয়া।
শীত মৌসুমে সমস্ত গাছপালা শুষ্ক এবং বিবর্ণ রুপ ধারণ করে। পাতাঝরা বৃক্ষগুলো ন্যাড়া মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে। শীতের রুক্ষতা আর শুষ্কতায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে সমস্ত প্রকৃতি। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-কুয়া সব শুকয়ে যায়। উত্তরে হাওয়ার সাথে আসে হাঁড় কাঁপানো শীত। আসে শৈত্য প্রবাহ। এ সময় তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে নেমে আসে। এমন শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ যার কাছে যা গরমের কাপড় আছে তা গায়ে জড়িয়ে শীতের মোকাবেলায় নেমে যায়। দরিদ্র মানুষ ও বৃদ্ধ নারী-পুরুষদের এ সময়ে কষ্টের সীমা থাকেনা। গরম কাপড়ের অভাবে অনেক হত দরিদ্র মানুষ কষ্ট পায় এবং অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করে থাকে। গ্রাম, বাজার ও মোড়ের চা দোকানে সকাল হতেই জমতে থাকে মানুষের জটলা। যার যার সাদ্যমত শীতের চাদর, শাল, কাঁথা, জাম্পর, সোয়াটার, মাফলার, কারো মাথায় টুপি গল্পে গল্পে একের পর এক খালি হতে থাকে চা’য়ের কাপ। চিরাচরিত গ্রাম-বাংলার এই শীতঋতু।
শীতের সকাল বাঙালী জাতির জীবনকে করেছে বৈচিত্রময়। শীত আমাদের জীবনে আশির্বাদ যেমন, তেমনি অভিশাপও বটে দু’য়ের সমন্বয়ে। অপরূপ শীতের সৌন্দর্য্য অনুভবে ও উপভোগে ভুলে যাওয়া যায়না সেইসব ছিন্নমূল মানুষের কথা। এক টুকরো শীতের কাপড় বা মাথা গোঁজার ঠাই নেই যাদের, তাদের জীবনে শীত আনন্দ নয় বরং অভিশাপ। শীতের অভিশাপ থেকে শীতার্ত মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি পড়ে প্রথমত দেশের শাসকদের উপর। এর পরে সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, এনজিও, ক্লাব, মানবিক সংগঠন এবং সমাজের বিত্তবানসহ নিজ উদ্যোগে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত শীতার্ত অসহায় মানুষের পাশে। অভাবী মানুষের শীত বস্ত্র অভাব মোচনে দলমত নির্বিশেষ সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিযে আসা উচিত।