গ্রেফতার ও প্রতিপক্ষের হামলা এড়াতে পুরুষ শূন্য নলডাঙ্গার কোঁচকুড়ি গ্রাম

আপডেট: ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

নাটোর অফিস


খাস জমি নিয়ে সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের একজন নিহত হওয়ার পর থেকে নাটোরের নলডাঙ্গার কোঁচকুড়ি গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। পুলিশি অভিযানের পাশাপাশি নিহতের সমর্থকদের হামলা ও হুমকির মুখে ওই গ্রামের নারীরা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পুরুষ সদস্যদের না পেয়ে পুলিশ নারী সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়ায় আতঙ্ক বেড়েছে। এখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকছে ওই গ্রামের নারীরা। ইমাম-মুয়াজ্জিনরাও আতঙ্কে গা-ঢাকা দেওয়ায় ওই গ্রামের মসজিদগুলোতে এখন আজানের ধনি ও নামাজ হয় না। পুলিশ বলেছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক নারীকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার হালতিবিলের প্রায় ১১ একর খাস জমি দখল নিয়ে চাঁদপুর ও কোঁচকুড়ি গ্রামের মধ্যে ১৭ ডিসেম্বর সংঘর্ষ হলে সামাদ মোল্লা (৪৫) নামে চাঁদপুর গ্রামের একজন নিহত ও অন্তত ৭ জন আহত হয়। ওই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী কোঁচকুড়ি গ্রামের ৪৩ ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করে। গ্রামের নারীদের অভিযোগ পুলিশ আসামিদের ধরতে ওই গ্রামে অভিযান চালানোর নামে চাঁদপুর গ্রামের অভিযুক্তদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। চাঁদপুর গ্রামের সন্ত্রাসীরাও পুলিশের সাথে ওই গ্রামে গিয়ে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। গ্রেফতার আতঙ্ক ও সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে গ্রামটি এখন পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। পুলিশ এক নারীকে আটক করলে নারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্ভ্রম হারানোর আশঙ্কায় রাত কাটাচ্ছেন তারা। বাজার করতে না পরায় ছেলে সন্তান নিয়ে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে গ্রামের অধিকাংশ পরিবারকে। অন্য গ্রাম থেকে বাজার হাট নিয়ে স্বজনদের বাঁধা ও হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে নিহতের সমর্থকরা।
এদিকে নলডাঙ্গা উপজেলার হালতি বিলের প্রত্যন্ত কোঁচকুড়ি গ্রামে গেলে কাউকে পাওয়া যায় নি। গ্রাম জুড়ে ছিল শুনশান নিরবতা। পুলিশের লোক বা সন্ত্রাসী ভেবে গ্রামের নারীরা বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে গা ঢাকা গিয়ে আড়ালে নজর রাখতে থাকে। এর মাঝে  দু’একজনের দেখা মিললে তাদের কাছে সাংবাদিক পরিচয় জেনে আতঙ্কিত নারীরা প্রকাশ্যে বের হয়ে আসেন। এসব নারীদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ।
মুখে কাপড় ঢেকে অনেকেই তাদের পরিচয় জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আসামি ধরার নামে পুলিশ রাত্রিতে গ্রামে হানা দিয়ে তাদের গাল মন্দ করে ঘরের তালা ভেঙে মালামাল তছনছ করে। এসময় পুলিশের সাথে সন্ত্রাসীরাও ভাঙচুরে অংশ নেয়। সংঘর্ষের সময় আহত ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেনরে ভাইসহ অন্য সন্ত্রাসীরা পুলিশের সঙ্গে গ্রামে প্রবেশ করে ভয় ভিতি দেখায়।
কোঁচকুড়ি দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নাসিমা বেগম জানান, তার স্বামী রফিকুল ইসলাম চোখে দেখে না। তিনি দক্ষিণপাড়া মসজিদে আজান দিতেন। কিন্তু পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে তিনিও পালিয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে আছেন। কোথায় আছেন তিনি জানেন না। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর সেখানে নারীদের জটলা বাড়তে থাকে। এসময় জটলা বাধা নারীদের কয়েকজন, মনোয়ারা বেগম, রেহেনা, হাসিনা বেগম ও সাহারা বেগম জানান, পুলিশ পুরুষ মানুষ না পেয়ে জিল¬ুরের বউকে ধরে নিয়ে গেছে। রাতে গ্রামে ঢুকে তারা বাড়ির তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর চলায়। এসময় চাঁদপুর গ্রামের সন্ত্রাসীরাও পুলিশের সঙ্গে ছিল। পুলিশ জজের বউ মনোয়ারা ও মহসিনের বউ সেলিনাকে ধরার চেষ্টা করে। এসময় তারা প্রাণভয়ে পালালে পুলিশও পিছু ধাওয়া করে। রাতের অন্ধকারে তারা বিলের মধ্যে গিয়ে অবস্থান নিয়ে রক্ষা পায়।
বাগাতিপাড়া উপজেলার লক্ষনহাটি এলাকার গৃহবধূ সেলিনা বেগম জানান, তিনি বাপের বাড়ি পাহারা দিতে এসেছেন। প্রতি রাতেই পুলিশ ও সন্ত্রাসী  গ্রামে হানা দিচ্ছে। মেয়েদের যা ইচ্ছে তাই বলে গালমন্দ করে। মেয়েরাও পাশের চান্দপুর বাজারে যেতে পারে না। চাঁদপুর বাজারে কোঁচকুড়ি গ্রামের লোকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। বাজার হাট করতে না পারায় অনেকের বাড়িতে অভুক্ত থাকছে। স্বজনরা খাবার বা বাজার দিতে আসলে তাদের পথে বাধা দেয়া হচ্ছে।
মর্জিনা বেগম, তহমিনা বেগম জানান, গ্রামটি পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ায় এই গ্রামের তিনটি মসজিদের সবকটি বন্ধ রয়েছে গত সাতদিন ধরে। এই তিনটি মসজিদে আজান দেয়ার লোক নেই। নামাজ আদায় বন্ধ হয়ে গেছে। ইমাম ও মুয়াজ্জিনরাও আতঙ্কে পালিয়ে রয়েছেন। গ্রামে এখন আর আজান হয় না। ফলে মোবাইল ফোনে সময় দেখে তারা এখন নামাজ আদায় করছেন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান কোঁচকুড়ি গ্রামের নারী সদস্যরা আতঙ্কে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, গ্রামটি এখন পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। তাই এক্ষেত্রে প্রশাসনের নির্দেশে ওই গ্রামের নিরাপত্তায় পাহারার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
নলডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তফা কামাল বলেন, কুচকুড়ি গ্রামের ১০ একর ৮৪ শতক জায়গা নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে সামাদ মোল¬া নামে একজন নিহত হওয়ার ঘটনার মামলা দায়ের করেছেন নিহতের স্ত্রী। মামলার আসামি ধরতে ওই গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে ভাঙচুরের অভিযোগ সঠিক নয়। তবে একজন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার কোন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।