রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৯ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
৪২ বছর আগে ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে বাঙালি জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নং ধানম-ি রোডের বাসায় হানা দিল একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতি। বাইরে দাঁড়িয়ে সামরিক পোশাক পরে হুইসেল দিল জিয়াউর রহমান। সশস্ত্র মিলিটারি তখন ধানম-ি এবং অন্যান্য এলাকায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতে হানা দিয়ে পরিবারের সকলকেই খুন করলো। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সেদিন বিদেশে ছিলেন। ঢাকা রেডিও থেকে খুনিরা দম্ভের সঙ্গে ঘোষণা করল, বাংলাদেশ নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মার্শাল ল জারি করা হয়েছে। এর আগে ১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় আল-বদর, আল শামস ও রাজকার বাহিনী দখলদারি খান সেনাদের নির্দেশে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে।
আজ সেদিন (১৫ আগস্ট) বিশ্বের তামাম বাঙালিরা কালো দিবস হিসাবে পালন করছে। সেদিনের ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ শোকমগ্ন হয়ে পড়ে। আমি নিজে রেডিও শুনিনি। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব প্রয়াত শরবিন্দু চট্টোপাধ্যায় ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাকে ফোন করে খবরটি দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে আনন্দবাজারের ম্যানেজিং এডিটর অভীক সরকারকে ঘুম থেকে তুলে খবরটা দিলাম। অভীক বাবু পরে রেডিও শুনে বললেন, ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমাদের আজ কিছু করার নেই, কারণ কাগজ ১৫ আগস্ট উপলক্ষে বন্ধ। একবার অফিসের বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, সকালে বিশেষ সংস্করণ বের করা যায় কিনা। তাতে অসুবিধা ছিল। কারণ সে সময় ভারতে জরুরি অবস্থা ছিল এবং সমস্ত কপি সেন্সর করাতে হত। সেদিন ছুটি বলে রাইটার্স বিল্ডিং- এ কোন ক্লার্ক উপস্থিত ছিলেন না।
জিয়া-বাহিনী এবং ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আবার সংযুক্তি ঘটাবে। বস্তুত প্রায় এক বছর আগে, আমি তখন ঢাকায় থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে বাড়িতে ডেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে বলেছিলেন, জিয়া তাঁর কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়ে জিয়া সামরিক শাসন চালু করবে। ্আমি তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। আপনি কলকাতা গিয়ে ভারত সরকারকে খবরটি জানান।
কলকাতায় বিদেশমন্ত্রক এবং বিএসএফ এর ডিজি প্রয়াত গোলক মজুমদারকে সব ঘটনা জানাই। তাঁরা দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং মন্ত্রকগুলিকে জানিয়ে দেয়। পরে ইন্দিরা গান্ধীর প্রচার সচিব এস ওয়াই সারদা প্রসাদ আনন্দবাজারের সম্পাদককে ফোন করে বলেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি দিল্লি যাই। কারণ প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকেছেন। টেলেক্স বার্তা পেয়েই সম্পাদক প্রয়াত অশোক সরকার আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। আমাকে বলেন, এখনই দিল্লি যান। প্রধানমন্ত্রী আমার কাছে জানতে চাইলেন, তাজউদ্দিন আমাকে কী কী বলেছেন। আমি তাকে বিশদে বললাম, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ব্যাখ্যা করলাম। পরদিন সকালে আবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ডেকে পাঠানো হল। আমি যা বলেছি তিনি তা টাইপ করিয়ে আামকে দেখালেন। এই যাবতীয় ঘটনা নিয়ে আমি একটি বইও লিখেছি- মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা। বইটি ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
ঢাকায় ফিরে গেলাম। আমার ডিউটি ছিল বিকেল চারটে থেকে বঙ্গবন্ধুর অফিসে গিয়ে যতক্ষণ তিনি থাকেন, ততক্ষণ বসে থাকা। এ ব্যাপারে আমি কৃতজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের কাছে। খবর পেতে তোফায়েল আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তখন খবরের কোনও অভাব ছিল না। হঠাৎ বঙ্গবন্ধুকে করিডোরে পেয়ে তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, এসব কী শুনছি এখানে। উনি আমার বুকে ঘুষি মেরে বললেন, আমি জাতির পিতা। আমারে মারবো কেডা? এসব গুজবে কান দেবেন না। তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, আমার সঙ্গে দু’এক মিনিট কথা বলেই ঘরে ঢুকে গেলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আনন্দবাজারের অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু জানতেন। তাঁকে জানিয়েছিলেন তাজউদ্দিন ও কামারুজ্জামান সাহেব। আমি কলকাতায় কামারুজ্জামান সাহেবকে অনুরোধ করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎকার পাইয়ে দিতে হবে। পাকিস্তান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লি হয়ে ঢাকায় পৌঁছলেন বঙ্গবন্ধু। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে রমনা ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী ময়দান) তিনি বললেন, আমি সকালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে সব শুনেছি। তিনি ঘোষণা করলেন- আমার দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের সব রকম অধিকার থাকবে। হিন্দুরা মন্দিরে যাবে, মুসলমানরা মসজিদে যাবে, এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই। এটা আমার হুকুম। তাঁর হুকুম কি এখন পালিত হচ্ছে?
এবারে আসছি মুক্তিযুদ্ধের সেই ন’মাসের কথায়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মেহেরপুরের- যা এখন মুজিবনগর নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হল। এই অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলি, বিদেশ মন্ত্রী মুজিব হত্যার অন্যতম নায়ক খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ। দপ্তর বণ্টন করতে গিয়ে এবং কলকাতায় যে গণপরিষদের বৈঠক হয়েছিল সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী এবং কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন। মেহেরপুরে কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবেই শপথ নিয়েছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মুক্তিবাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যা ঘটছে এর যাবতীয় তথ্য তাঁর কাছেই আসত। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে সব সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতেন। তিনি বেশিরভাগ সময় বসতেন কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিটে। এখানে সাংবাদিকদের ভিড় লেগেই থাকত। সেক্টর ভিত্তিক খবর তাঁর কাছেই আসত। অপরদিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন সাহেব ভারত সরকারের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কামারুজ্জামান সাহেব ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব হাসিমুখেই দিতেন। তাঁকে আমি দেখেছি, সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। ১৫-২০ দিন পরপর আমি তাকে বলতাম, আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে বলে সকলের সামনে আমি কথা বলব না। আমাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে হবে।
আমাদের যখন প্রথম আলাপ হয় তখন কামারুজ্জামান আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। একটা সময় আমাকে ‘তুই’ বলে ডাকতে শুরু করেন। এটুকু মনে আছে, একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ভারতের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছি। যে ত্যাগ ও প্রতিক্ষার মধ্যে দিয়ে বাঙালিরা সংগ্রাম করছে, তাতে জয় আমাদের হবেই। তারপর বললেন, জয় বাংলা। আমার প্রশ্ন ছিল, কতদিন লাগতে পারে, উত্তরে তিনি বলেছিলেন যৌথ বাহিনী গঠন হয়ে গিয়েছে। আমরা শীঘ্রই ঢাকা দখল করে নেব। ঢাকা দখলের আগে ওই চার মন্ত্রী যশোরে গিয়ে জনসভাও করেছিলেন। সেই জনসভায় চার নেতাই বক্তৃতা করেন। কামারুজ্জামান বলেছিলেন, এখন আমাদের নজর দিতে হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের দিকে। ইসলামাবাদ, ওয়াশিংটন এবং কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ইতি টানেনি। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চার নেতাকে হত্যা করা। জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ওই চার মন্ত্রীকে খোন্দকার মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর অফিসারদের পিস্তল নিয়ে তাদের বাসায় পাঠিয়েছিল। চারজনেই সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলে দিয়েছিলেন, আমরা এই অবৈধ সরকার মানি না। জিয়া স্বয়ং কামারুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে বলেছিলেন আপনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিন। আপনার এবং পরিবারের দায়-দায়িত্ব আমার। কামারুজ্জামান উত্তরে বলেছিলেন, ভয় দেখাবেন না। পদ্মার জল তো আগেই লাল করে দিয়েছেন। আবার নতুন করে লাল করতে চান? ভারতের তখনকার গোয়েন্দা সূত্রগুলি আমাদের বলত। মুক্তিযুদ্ধের ওই চার মহান নেতাকে গুম করার কোনও উপায় নেই, কারণ সামরিক বাহিনী তাদের গৃহবন্দি করে রেখেছে। কিছুদিন গৃহবন্দি রাখার পরে তাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিছুদিন পর জেলের অভ্যন্তরে জিয়া বাহিনী গুলি করে তাদের হত্যা করে। এই খবর ব্যক্তিগতভাবে শুধু মর্মান্তিক নয়, গভীর শোকের বিষয়। হত্যার পরদিন সকালে আমাকে টেলিফোনে সেই শরদিন্দু বাবু খবরটি দিয়ে বললেন, রেডিও শুনুন। রেডিও খুলেই শুনি মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর। তিনি বলছেন, আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুষ্ট হল। আর জয় বাংলা স্লোগান নয়, এবার বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান। আমি বিদেশে চললাম। সেই যে তিনি বিদেশ গেলেন, আজ পর্যন্ত ভারত বা বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তাঁর খোঁজ পাননি। এরপর আবার শরদিন্দু বাবুর ফোন এল। তিনি বললেন, কামারুজ্জামানের দুই ছেলে লিটন ও স্বপন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেলে থাকে। হত্যাকারীরা নরেন্দ্রপুরের আশেপাশে ঘোরাঘোরি করছে। ওদের দু’জনের নিরাপত্তার জন্য আমি আপনাদের বাড়িতে নিয়ে আসছি। স্বপন ও লিটনকে কিছুদিন আমার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার স্ত্রী ওদের সান্ত¦না দিত। আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ়। কিছুদিন পর ওরা কান্নাকাটি করতে থাকল। শরদিন্দু বাবুকে তা জানালাম। তিনি বিদেশমন্ত্রকের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান। ইন্দিরা সরাসরি ফোন করে জিয়ার কাছে জানতে চান, ওরা দেশে ফিরলে তাদের প্রাণের ক্ষতি হবে কিনা। তখন ভারতের বিদেশ সচিব জিয়াকে ফোন করে লিখিত প্রতিশ্রুতি চান। জিয়া সেই লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলে বিএসএফ ওদের মা অর্থাৎ কামারুজ্জামানের স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বই লেখার অপরাধে জিয়া আমার সেদেশে যাওয়ার ভিসা বাতিল করে দেন। তাই ওদের সঙ্গে আমার গত ৪০ বছরে কোনও যোগাযোগ হয়নি। বছর সাত-আট আগে দিল্লি বিমানবন্দরে স্যুট-বুট পরা একটি ছেলে এসে প্রণাম করে। আমি পরিচয় জানতে চাইলে সে বলে, আমি স্বপন। আপনার বন্ধু কামারুজ্জামানের ছেলে। তখন ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সে এখন বাটা কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত। গত বছর ডিসেম্বর মাসে ঢাকা সফরকালে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসে আলাপ হয়েছিল জয়েন্ট সেক্রেটারি আবদুর রহমানের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি লিটনের কথা তোলেন। তিনিই টেলিফোনে সেদিন লিটনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন।
বছরের পর বছর কেটে গেল। এত বছর বাদে যে যোগাযোগ হল, সেটাই কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হল, যে ঘুমের রাজনীতি পাকিস্তান শুরু করেছিল, তা এখনও সমাজে সক্রিয়। বঙ্গবন্ধু- কামারুজ্জামানদের পরের প্রজন্মের হাতেই এখন সেই অসমাপ্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব।
লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক, ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মানপ্রাপ্ত