শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১২ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
সালাম হাসেমী
সকাল ১১টায় পাবনা মানসিক হাসপাতালের সম্মুখে একটা মাইক্রোবাস এসে থামল। মাইক্রোবাসটিতে চঞ্চলকে হাত বাঁধা অবস্থায় দু’জন লোক ধরে নামিয়ে হাসপাতালের ভিতর ডাক্তার ইরফান সাহেবের চেম্বারে নিয়ে গেল। ডাক্তার সাহেব তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হাসপাতালে ভর্তি করার আদেশ দিলেন। ভর্তি করা হল। যেহেতু চঞ্চল এই হাসপাতালে নতুন রোগী এবং একেবারে বদ্ধ পাগল তাই তাকে পৃথক একটি ছোট্ট কক্ষে রাখা হল, যাতে অন্যান্য রোগীর সাথে কোন প্রকার মারামারি ও ধস্তা ধস্তি না হয়। এক নার্স এসে চঞ্চলকে ঘুমের ও মানসিক রোগের ইনজেকশন দিয়ে গেল।
অল্পক্ষনের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু বেশীক্ষণ সে ঘুমালো না। অল্প ক্ষণ সে ঘুমিয়ে আবার জেগে উঠে আবল তাবল কথা বার্তা বলতে লাগল, আর তার কক্ষের দরজার রড ধরে টানাটানি করে দরজা খোলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কয়েক বার কয়েক জন নার্সকে দরজা খুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করল কিন্তু তারা কর্ণপাক করল না। চঞ্চলকে হাসপাতালে এই কক্ষে রাখার পর হতে সে তার কক্ষের দরজা খুলে বাহিরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু সে পারল না। না পারার দরুন সে অনর্গল ধাককিয়ে যাচ্ছে।
্এই ভাবে দুপুর পার হয়ে গেলে বিকেল ৪ টার সময় ডাক্তার সাদিয়া ইয়াসমিন কাঁকন হাসপাতালে প্রবেশ করলেন। তিনি চঞ্চলের কক্ষের পাশর্^ দিয়ে তার কক্ষে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে চঞ্চল ডাক্তার সাদিয়া ইসলাম কাঁকনকে তার কক্ষের দরজা খুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পারলেন। চেনার পরেও তার মনে সন্দেহ হল চঞ্চল এখানে আসবে কি করতে। কাছে গিয়ে ভালো করে পরখ করে তাকে জিজ্ঞেস করল, -তোমার নাম কি ? -ডালিম কুমার ।
পিতার নাম ?
-মুকুটরাজ ।
বাড়ি কোখায় ?
-বৈরাট নগর ।
ডাক্তার কাঁকন চঞ্চলকে দেখে ঠিকই চিনতে পেরেছেন এবং তার এভনরমাল কথা বার্তা শুনে পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারলেন যে চঞ্চল বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। কারণ সে যে নাম ঠিকানা বলল তা সঠিক নয়। কাঁকন জানে যে তার নাম চজ্ঞল চৌধুরী ,বাবার নাম সমসের আলী চৌধুরী , তার বাড়ি কাশদোলা গ্রামে। এই চঞ্চল ও কাঁকন প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ্একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একই শ্রেণিতে লেখা পড়া করেছে। উচ্চ মাধ্যামিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কাঁকন ভর্তি হল মেডিকেল কলেজে এবং চঞ্চল ভর্তি হল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। শৈশব কাল হতে একের প্রতি অপরের গভীর টান ছিল। এই টানই যৌবন বয়েসে এসে প্রেম ও ভালোবাসায় পরিণত হয়।
তারা উভয় ঢাকা থেকে পড়ালেখা করেছে। ছুটির দিন ও অবসর সময়ে তারা দু’জন আড্ডা দেওয়ার জন্য চলে আসতো রমনা পার্কে, টিএসসি এর চত্বরে, পাবলিক লাইব্রেরির সামনে , লালবাগ কেল্লা ও ঢাকার বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে। তাদের ভালোবাসা এমন রূপ ধারণ করেছিল যে একে অপরকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতো না। এমনি মানিক জোড় ছিল তারা। এমনি যখন তাদের ভালোবাসার রজ্জু পরস্পর পরস্পরের সাথে শক্ত গিটে বাঁধা ঠিক তখন্ই তাদের ভালোবাসার রজ্জুর গিট ছিন্ন হয়ে গেল, যখন কাঁকন এম, বিসিএস পাস করল ওদিকে চঞ্চল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করল তখন। পাসের পর চঞ্চল চাইল কাঁকনকে বিয়ে করতে কিন্তু কাঁকন বল যে সে বিদেশ হতে উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে ফিরে এসে বিয়ে করবে।
কিন্তু চজ্ঞল কাঁকনের কথায় রাজি না হয়ে অভিমান করে তার সাথে কথা বলতো না। তার কাছে আসতোই না। আগের মত সংগো দিতো না । একদিন কাঁকন উচ্চ শিক্ষার বৃত্তি নিয়ে চলে গেল সুদূর কানাডায়। চঞ্চল কাঁকনের প্রতি অভিমান করেছে। কানাডায় যাওয়ার পূর্বে কাঁকন চঞ্চলের সাথে দেখা করে তার নিকট হতে বিদায় না নিয়ে কানাডায় চলে গেল। কানাডায় যাওয়ার পর অভিমান করে কাঁকনও চঞ্চলের নিকট কোন চিঠি পত্র লিখল না ও ফোন আলাপের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করল না। চঞ্চলও কাঁকনের মত কোন যোগাযোগ রক্ষা করল না। চঞ্চল মনে মনে ধরে নিল কাঁকন তাকে ভুলে গিয়েছে। এই ভুলে যাওয়াটা সে সহ্য করতে পারল না।
কাঁকন তাকে ভুলে গিয়েছে এই কথা ভাবতে ভাবতে মাঝে মাঝে রাগে সে তার মাথার চুল ধরে টানতে থাকে। কাঁকনের সাথে তার শৈশব কালের প্রেম। এই দীর্ঘ দিনের ভালোবাসা কাঁকন কি করে ভুলে গেল এ কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় তার মাথায় বিকৃতি ঘটল। ধীরে ধীরে সে এক জন মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে বদ্ধ পাগলের রূপ নিল। তখন তাকে বাড়ি রাখা সম্ভব নয় বলে তার বাবা তাকে পরিশেষে চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিল।
ডাক্তার কাঁকন ভাবতে লাগল কি করে চজ্ঞলকে সুস্থ করা যায় ? তার প্রেমের বিচ্ছেদের কারনেই চজ্ঞল আজ বদ্ধ উন্মদে পরিণত হয়েছে। যেহেতু সে প্রেমের ব্যর্থতার কথা ভেবে ভেবে আজ সে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং তার চিকিৎসা কেবল মাত্র এই মানসিক রোগীর ওয়াডে রেখে করলে চলবে না। তার সাথে কাঁকনের সংগো দিতে হবে। তার মনের পরিবর্তন আনার জন্য তাদের পূর্বের প্রেমময় জীবনের বিচরণের স্থানগুলো ঘুরিয়ে, পূর্বের আচার ব্যবহার করে তার মনের পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই সে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারে।
তখন কাঁকন হাসপাতালের সুপারেনরেন্ট এর নিকট হতে অনুমতি ও ছুটি নিয়ে, প্রথমে তারা গেল তাদের কলেজে, যে কলেজে তারা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছে। কলেজের পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গিয়ে ঘাসের বুকে বসল। সেখানে বসে কাঁকন চঞ্চলকে বলল,‘আচ্ছা, চঞ্চল তোমার কি মনে আছে আমরা এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে গল্প করতাম, আর তুমি সেই গল্পের ফাঁকে একদিন কাজী নজরুল ইসলমের ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল।’
এই গান গেয়ে গানের শেষে আমার খোঁপায় ফুল পরিয়ে দিয়ে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতে। আমি লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলতাম যে, অমন করে কি দেখছো ? তুমি আমার থুতনি ধরে বলতে তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়।’ একথা বলার পর চঞ্চল তার অতীতকে ভাবতে গেল কিন্তু আবছা একটু স্মৃতিতে এলো। কিন্তু তা পরিস্কার নয়। কলেজে আসার দু’দিন পরে কাঁকন শুনল যে, কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে আগামী পরশু। একথা শুনে কলেজের কতৃপক্ষের নিকট প্রাক্তন ছাত্রী হিসাবে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠান করার অনুমতি চাইল এবং সে অনুমতি পাইল। কাঁকন ভাবল তারা যখন এই কলেজে পড়তো তখন একবার নবীন বরণ অনুষ্ঠানে কাঁকন নেচে ছিল।
সে ন্চা দেখে চঞ্চল খুশি হয়ে তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। সে কথা ভেবে কাঁকন চঞ্চলকে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। সে অনুষ্ঠানে কাঁকন নাচল এবং ভাবল যে, এই অনুষ্ঠান দেখে তার অতীতের স্মৃতি কিছু মনে পড়ে কিনা ? কাঁকনের আজকের নাচ দেখে চজ্ঞলের স্মৃুতিতে আবছা কিছু স্মৃতি ফিরে এলেও তা তৎক্ষণাৎ নিষ্ক্রীয় হয়ে গেল।
এভাবে যখন কিছুতেই কাঁকন চঞ্চলের মনে অতীতের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারল না তখন তাকে নিয়ে সে ঢাকা গেল এবং সেখানে গিয়ে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিল। ঢাকাতে সে তাদের শিক্ষা জীবনের অতীতের স্থানগুলো ঘুরে বেড়াল এবং চঞ্চলের সাথে অতীতের ন্যায় কার্য কলাপ করল। তাতে কিছুতেই কিছু হল না। ঢাকা গিয়ে কাঁকন সব সময় চঞ্চলের পকেটে পর্যাপ্ত টাকা রেখে দিতো এই আশায় যে, অতীতের স্মৃতি মনে পড়লে ছাত্র জীবনে সে বিভিন্ন সময় বি্িযভন্ন জিনিস কিনে কাঁকনকে দিতো ও খাওয়াত, সে রকম কিছু এখন করে কিনা ? এক দিন চঞ্চল বাসায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে।তাকে ঘুমাতে দেখে কাঁকন চঞ্চলের জন্য বিশেষ একটি খাদ্য রান্না করার জন্য রান্না ঘরে গেল। এই ফাঁকে চজ্ঞল ঘুম হতে ঊঠে বাহিরে চলে যায়।
একটি সি. এন. জি. ভাড়া করে সে বোটানিক্যাল গার্ডেনে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সে পার্ককের ভিতর দিয়ে ঘুরতে থাকে। এক ছিনতাইকারী চঞ্চলকে দেখে তার কাছে আসে । তারা তার কাছে এসে দেখে একগোছা এক হাজার টাকার কত গুলো নোট তার পকেটে অর্ধ বের আকারে বেরিয়ে আছে। ছিনকাইকারী চঞ্চলের নিকট এসে তার মুখ মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে লোকটি মানসিক রোগী। তাই তারা ভাবল যে মানসিক রোগীর নিকট হতে টাকা নিলে কিছু হবে না। তারা চঞ্চলের পকেট হতে টাকা থাপা দিয়ে নিয়ে নিলো। চঞ্চল একজন ছিনতাইকারীকে ধরে কয়েকটি ঘুষি মারে। তা দেখে অন্যান্য ছিনতাইকারীদের মধ্য হতে একজন এসে চঞ্চলের মাথায় আঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দিল।
এদিকে কাঁকন পাকের ঘর হতে চঞ্চলের রুমে এলো তার খোঁজ খবর নিতে দেখল সে তার রুমে নাই। তখন তার ফ্লাটের সব গুলো রুম ও জায়গা খুঁজল এবং ঐ বিডিংয়ের অন্যান্য তলা ও ফ্লাট খুঁজল কিছুৎেই তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। তার পরে তার আশে পাশের বিলডিং ও তার আশে পাশের বিভিন্ন স্থান তন্নতন্ন করে খুঁজল। তার পরে বেরুল তার ফ্ল্যাট হতে ঢাকার শহরের বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে। পার্ক টিএসসি এর মোড়, লালবাগ কেল্লা ইত্যাদি স্থানে খুঁজল কোথাও তাকে পাওয়া গেল ন্।া পরিশেষে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
সেখানে তাকে অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেল। মাথা হতে রক্ত ঝরছে। তখন তাকে কতিপয় লোকের সহায়তায় সিএনজি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করল। হাসপাতালে ভর্তি করার পরের দিন খুব চঞ্চলের জ্ঞান ফিরলো। হাসপাতালে ভর্তি করে কাঁকন সারাক্ষণ তার পাশে বসে ছিল। জ্ঞান ফিরলে চজ্ঞল তার বেডের চার দিকে তাকাল। তাকিয়ে সে যাকে তার বেডের পাশে দেখল তাকে প্রথমে চেনার চেষ্টা করল কিন্তু তার স্মৃতি পরিষ্কার ভাবে এলো না। তাকাতে তাকাতে এক সময় চঞ্চল কাঁকনকে চিনতে পারল। চিনতে পেরে কাঁকনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে প্রশ্ন করল,
ঃ তুমি কাঁকন না ?
ঃ হ্যা, আমি কাঁকন।
ঃ তুমি আসলে কোথা থেকে ? আর আমি এখানে কেন ? তখন কাঁকন সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলল। কাকাঁনের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে চঞ্চল অভিমান করে হাসপাতালের বেড হতে উঠে বাহিরে চলে যেতে যেতে বলতে লাগল , তুমি তো আমার প্রেম ও ভালোবাসাকে প্রত্যাখান করে কানাডায় চলে গেছো। এখন আবার আমার কাছে ্এলো কেন ?
ঃ চঞ্চল, আমি তোমার প্রেম প্রত্যাখান করিনি। আমি তোমারকে বিয়ে না করে কানাডা চলে গেলাম বলে তুমি যেমন আমার সাথে অভিমান করেছিলে, সেই রূপ ভাবে আমিও তোমার সাথে অভিমান করেছিলাম । আজ আর অভিমান নয়। আমি আমার চঞ্চলকে ফিরে পেয়েছি। আর তোমাকে আমি হারাতে চাই না। চল আমরা বিয়ে করব।
কাঁকনের কথা শুনে চঞ্চল কাঁকনকে দু’বাহুর বেষ্টনের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে তার থুততুনি ধরে বলল,
‘ঠিক ঠিক তুমি বিয়ে করবে ?’ কাঁকন চঞ্চলের চোখে চোখ রেখে ‘ঠিক’ বলে হাঁ – হাঁ – করে হেসে দিয়ে চঞ্চলের হাত ধরে হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালের এলাকা ছেড়ে। হাসপাতালের বাহিরে এসে কাঁকন ভাবল তাদের জীবনের অন্ধকারের ঘোর কেটে গিয়ে ‘ সোনালী ভোর হয়েছে।’ সেই ভোরে তারা দু’জনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন তাদের হৃদয় ও নয়নে ভিড় করেছে।