চলতে গেলে বলতে গেলে থামতেও হয়

আপডেট: নভেম্বর ১০, ২০২১, ১২:২১ পূর্বাহ্ণ

আব্দুল মজিদ:


চলৎশক্তিসম্পন্ন মানুষ নিজেদের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শুধু সামনের দিকে চলছেই না বরং বলা যায় যাপিত জীবনের মান উন্নয়নের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টাও গোড়া থেকেই চালিয়ে আসছে। লেখা বাহুল্য মানুষ যদি তা না করতো- তাহলে তো সভ্যতার কোনো দৃশ্যমান উন্নয়নই ঘটতো না। মানুষ হয়তো আজও গুহাবাসী হয়েই দিনাতিপাত করতো। সামনের দিকে তথা প্রগতির দিকে এগিয়ে চলার সাথে সাথে মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলাও শিখেছে। একে অপরের সাথে ভাব বিনিময় তথা তথ্যের আদান প্রদান করতে শিখেছে, ঘর বাঁধতে শিখেছে, আগুন জ্বালাতে শিখেছে, কৃষিকাজ করতে শিখেছে এবং আস্তে আস্তে মানুষ নিজে যেমন সাজতে শিখেছে তেমনি অপরকে সাজাতেও শিখেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন এবং সাংবাৎসরিক জীবনযাত্রাকে কেমন করে আরও বেশি আরামদায়ক করা যায় তার জন্য বহুমুখি ও সময়োপযোগী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে শিখেছে জন্যই গবেষণানির্ভর জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাও শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। আর এই প্রতিযোগিতায় যে জাতি, যে দেশ যত উন্নতি করতে পেরেছে তারাই বলতে গেলে বর্তমানে চালকের আসনে। শিক্ষা-দীক্ষা,গবেষণায় উন্নতি লাভের সাথে সাথে মানুষের লোভ-লালসা যাকে বলে ভোগলিপ্সা, ক্ষমতার প্রতি মোহ, নিজেদের শক্তিমত্তার আস্ফালনও বেড়ে গেছে বহুগুণ। আর তার জন্যই এ সব প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতেই মানুষকে প্রকৃতির ওপর অবিবেচকের মতো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে হচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে প্রকৃতির ওপর নির্বিচার হস্তক্ষেপ। এর যেন কোনো বিরতি নেই। মানুষ কেন যেন থামতে ভুলে গেছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে মানুষ পরিবেশের নিজস্ব জমানো সম্পদ এবং বিভিন্ন উপাদানগুলোকে নির্লজ্জের মতো ধ্বংস করছে। নিজেদের তথাকথিত সুখের জন্য প্রকৃতির ওপর বিরামহীন অত্যাচারের প্রতিশোধ হিসেবেই হয়তো কভিড-১৯ মানুষের চৈতন্যে এক বড় ধরনের ঝাঁকি দিয়ে বুঝিয়ে দিল প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তা করা যায় না। আর করলেও তার পরিণাম কখনোই সুখকর তো নয়ই বরং তা হয় রীতিমতো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বর্তমান কভিড-১৯ বিপর্যয়ও হয়তো এক ধরনের পূর্বাভাষ। আর এই পূর্বাভাষ বা সতর্ক বার্তা বুঝতে ব্যর্থ হলে ধরণীর বুকে মানুষের অস্তিত্বই মহাসংকটে নিপতিত হবে বলেই বিজ্ঞজনের বিশ্বাস। সুতরাং হে মানুষ তোমরা থামো, বন্ধ করো তোমরা তোমাদের এই সুখ সুখ খেলা। থামতে শেখো।
কথা বলার ক্ষেত্রেও মানুষ যেন আজ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে, তা সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হোক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হোক, রাজনৈতিক বক্তৃতা বিবৃতিতে হোক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটেই হোক বা ব্যক্তি পর্যায়েই হোক, কেউই যেন হারতে চায় না সবাই জিততে চায়। সবাই সবার চেয়ে বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। হায়রে মানুষ! এতে করে যে কেউই জেতে না, তা কেউ বুঝতে চায় না। সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রাম্পীয় আলাপ আলোচনা বহুত দেখা গেল। নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে, সমুদ্রে যুদ্ধ জাহাজের মহড়া নিয়ে, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, আইএসএস নিয়ে কত কথা, কত মিটিং, কত সিটিং কিন্তু ফলাফল শূন্য। শুধু কথার ফুলঝুরি। তাই বলি ভাই কথা থামাও কাজ করো দরকারি। কাজের কাজ বড়ই জরুরি।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের লাগামহীন বক্তৃতা বিবৃতির বহর দেখে রীতিমতো দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা। পারস্পরিক দোষারোপ থেকে শুরু করে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি তথা নানা বিষয়ে গলাবাজির যে মহড়া প্রতিনিয়ত দেখতে এবং শুনতে হয় সে সম্পর্কে কিছু না বলাই নিরাপদ। ইদানিং বিভিন্ন চ্যানেলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যকার বিষয় নিয়ে টক শো’র নামে, বলতে গেলে যে বিরামহীন আলাপ-আলোচনা হয় তার পরিণতি অনেক সময়ে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। অফ লাইনে আরও যে কী হয় তা তো আর দেখা যায় না, তবে অনুমান করা যায়। এখানে সবই আছে শুধু থামার সংস্কৃতিটাই নাই। কথা বলার সুযোগ পেলে আর যায় কোথায়, কত রকমের জ্ঞান, কত প্রকারের বিজ্ঞান, কত দর্শন, কত সাহিত্য, কত ধাঁচের, কত প্যাঁচের কথার যে অবতারণা হয় তার হিসেব মেলানোই কঠিন। এখনেও থামার সংস্কৃতির বড়ই আকাল।
ব্যক্তিগত পর্যায়েও দেখা যায়, হোক সে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত, ঘরে-বাইরে অন্য যারা আছে তাদের সাথে বা নিজের জীবন সঙ্গীর সাথেও কত যে কথা, কত যে বাক-বিত-া, কত যে রাগ, কত যে মান অভিমান তার কি লেখাজোখা আছে! কথার ঘায়ে, কথার জোরে, কথার ভয়ে, কথার লয়ে বকাবকি, গালাগালি, চুলাচুলি, কোনো কোনো সময়ে তা মারামারিতেও পৌঁছে যাচ্ছে। বলতে যে মেধার প্রয়োজন, চুপ থাকতে তার বেশি মেধা ও ধৈর্যের প্রয়োজন, যেটা বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই বেশ কম দেখা যায়।
যাহোক, এতদসংক্রান্ত বিষয়ে ডা. এমদাদুল হকের লেখা পড়ে যা বুঝেছিলাম অবলীলায় তা হলো কথার জেরে গলায় দড়ি, কথার ফেরে ডুবে মরি, তাও দেখা যায় ভুরি ভুরি। এতো কিছুর পরও কথার কমতিও নাই, খামতিও নাই। তবে আমি বলি সবার হিতে, সবার স্বার্থে এখানেও থামা দরকার। থামলে ভালো হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, কথাটার মর্মার্থ হলো, মানুষের এই চলার, করার এবং বলার ক্ষেত্রে নিজেদেরসহ পৃথিবীর সকল জীব অর্থাৎ সকল কিছুর স্বার্থেই মাঝে মধ্যে থামতে হয়। চলার শক্তি আসে থামা থেকে। আমরা দুই পায়ে হাঁটি। দু’টি পা যদি একসাথে ফেলি, তবে আমি নিশ্চিত হাঁটা হবে না, বড় জোর লাফালাফি হবে। বেশি দূর যাওয়া যাবে না। বাম পা থামিয়ে ডান পা ফেলতে হয়। ডান পা চলার শক্তি পায়, থেমে থাকা বাম পা থেকে। এভাবেই মানুষ ভারসাম্য বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এবং এই বুদ্ধিমত্তার সাথে চলার, বলার এবং করার মধ্যে এক ধরনের পরিমিতিবোধ কাজ করে, যা খুবই জরুরি। শক্তির উৎস হলো থামা। মানুষের মন হলো জলের মতো। জল থামলে স্বচ্ছ হয়। মনও থামলে তা শান্ত হয়। থেমে থাকা জলে ঢিল ছুঁড়লে প্রান্ত পর্যন্ত তরঙ্গ ছড়িয়ে যায়। স্রোতের মধ্যে ঢিল দিলে বুঝাই যায় না। মনও এমনি। মনের শক্তি অনেক কিন্তু থামার শক্তি অনন্ত। সুতরাং চলুন আমরা জীবন রথে চলতে গিয়ে থামতে শিখি।
লেখক : প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ।