সেলিম সরদার, ঈশ্বরদী :
রাজশাহী থেকে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন হয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি বগিতে বসা বেশির ভাগ যাত্রীরা তখন ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে। ট্রেনটি ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন অতিক্রম করার পর ওই বগিতে শাহিন হোসেন নামের এক বই বিক্রেতা প্রত্যেক যাত্রীর হাতে তুলে দিলেন একটি দুটি করে বই। মুহূর্তেই চলন্ত ট্রেনের চিত্র বদলে গেল। শিশুরা মোবাইলে গেম খেলা বাদ দিয়ে মগ্ন হলো কার্টুন, ছড়া কিংবা ভুতের শিশুতোষ গল্প পড়ায়। নারী ট্রেনযাত্রীরা প্রিয় লেখকের উপন্যাস, গল্প কিংবা ঘর সাঁজানো, রান্নাবান্নার নতুন নতুন রেসিপির খোঁজে অথবা রূপচর্চার নানান ধরনের বই নিয়ে। বয়স্ক ও মধ্যবয়সী যাত্রীরা কেউ ভ্রমন কাহিনী, কেউ সায়েন্স ফিকশন আবার কেউ মনযোগ দিলেন গল্প কিংবা উপন্যাস পড়ায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই মোবাইলে গান শোনা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত থাকার বদলে ট্রেনের এসি বগির যাত্রীরা মনযোগী হয়ে উঠলেন বই পড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টে গেল ট্রেনের এসি বগির চিত্র।
পাবনার ঈশ্বরদীর পশ্চিমটেংরি এলাকার বাসিন্দা শাহীন হোসেন সারা বছর ট্রেনে বই বিক্রি করে জীবন যাপন করলেও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে চলন্ত ট্রেনে ট্রেনযাত্রীদের বইমুখি করতে এই অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সাধারণত প্রতিদিন তিনি ট্রেনের কয়েকটি এসি বগিতে বই বিক্রি করে থাকেন। কয়েকদিন আগে তার ভাবনায় আসে ভাষার মাসে মানুষকে বই পড়ানোয় আগ্রহী করে তোলার বিষয়টি। সেই ভাবনাকে কাজে লাগাতে তিনি বিভিন্ন বয়সী পাঠকের কথা ভেবে প্রায় ১ মাস ধরে ঢাকার বাংলাবাজারে গিয়ে প্রচুর সংখ্যক নানান ধরনের বই সংগ্রহ করেন। গত বুধবার তিনি ট্রেনে এসব বই নিয়ে ওঠেন। ট্রেন ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন থেকে ঢাকা অভিমুখে চলা শুরু করলে তিনি একে একে এসি বগিতে বসা সকল যাত্রীদের হাতে একে একে বই তুলে দেন। তিনি বলেন, ট্রেন যাত্রীদের সবাইকে যে বই কিনতে হবে বিষয়টি তা নয়। সবাই চলন্ত ট্রেনে বই পড়ে সময় কাটানোর পর যদি কেউ বই কিনতে চান তাহলে কিনবেন, না চাইলে বইটি ফেরত দিবেন। বই পড়তে আগ্রহী করে তুলতে তাই শাহীন বেছে নিয়েছেন এই ব্যাতিক্রমী পদ্ধতি। শাহীন জানান, এই পদ্ধতিতে প্রতিদিন বাড়ছে পাঠকের সংখ্যা। ট্রেনে আগের চেয়ে বই বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। তার ভাষ্য অনুযায়ী এতে করে একদিকে যেমন বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে বই বিক্রি করে তার আয়ও ভালো হচ্ছে। তার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও।
বই বিক্রেতা শাহিন হোসেন এসব বিষয়ে বলেন, আমি বাংলাবাজারে ঘুরে ঘুরে ভাল মানের বই সংগ্রহ করি। নিজে বইগুলো পড়ে বই সম্পর্কে ধারনা নিয়ে তবেই অন্যকে পড়তে দিই। মানুষকে বই পড়িয়ে অন্যরকম আনন্দ অনুভব করি। এ কারণে চলন্ত ট্রেনের যাত্রীদের বই পড়ার সুযোগ দেই যেন চলতি পথে বই পড়ে তাদের সময়টা ভালো কাটে। পড়া শেষে কেউ বই ফেরত দেন আবার কেউ পছন্দ অনুযায়ী কিনেও নেন, এতে একদিকে মানুষ বই পড়ায় আগ্রহী হচ্ছে অন্যদিকে আমারও সংসারটা চলছে। এতেই আমার আনন্দ।
ওইদিন সিল্কসিটি ট্রেনে ভ্রমনকারী লন্ডন প্রবাসী আটঘরিয়া উপজেলার বাসিন্দা কাদের মাখন পড়ছিলেন হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘দেয়াল’ বইটি। তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সাধারণত ট্রেনে উঠে সময় কাটাতে মগ্ন থাকি মোবাইল নিয়ে। কিন্তু আজ ট্রেনে ওঠার কিছুক্ষণ পর আমার সামনে বই নিয়ে হজির হন এক বই বিক্রেতা। কয়েকটি বই নাড়াচাড়া করে প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল বইটি নিয়ে পড়তে পড়তেই ট্রেনভ্রমন করলাম। বিষয়টি আমার খুব ভাল লেগেছে।
রাজশাহী থেকে সিল্কসিটি ট্রেনের ‘গ’ বগিতে ছোট ছোট দুটি ছেলে-মেয়েকে সাথে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন সুমাইয়া আক্তার নামের এক নারী। তিনি বলেন, ৯ বছর বয়সী ছেলেটি জাফর ইকবালের লেখা দুটি বই, ৫ বছর বয়সী মেয়েটি কার্টুন ও ছবি আঁকার ৩টি বই পছন্দ করেছে। তাদের বই কিনে দেওয়ার পর আমি নিজেও নানা ধরনের ৪টি বই কিনেছি। আমরা এসব বই পড়তে পড়তে সুন্দর সময় কাটিয়েছি চলন্ত ট্রেনে।
ট্রেনযাত্রী চাটমোহর এলাকার দেবনাথ মন্ডল বলেন, আমি বই না কিনলেও চলন্ত ট্রেনে বেশিরভাগ সময় বই পড়েই কাটিয়ে দিয়েছি। পড়া শেষে বইটি বই বিক্রেতা শাহীনকে ফেরত দেওয়ার সময় তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘আপনি বই পড়েছেন, এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ’। তার এই সুন্দর আচরন আমার অনেক দিন মনে থাকবে।
ট্রেনের টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠু বলেন, মোবাইল আসক্তির কারনে অনেকেই এখন বই পড়া ভুলতে বসেছে। এই সময়ে ভাষার মাসকে সামনে রেখে একজন সাধারণ বই বিক্রেতা চলন্ত ট্রেনে মানুষকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা অনন্য উদ্যোগ বটে। ট্রেনে কর্মরত সবাই আমরা তাকে তার এই কাজে সহযোগিতা করি।
রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় বানিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ট্রেনে সাধারণত ক্যাটারিং সার্ভিসের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করা হয়ে থাকে। এর বাইরে ঈশ্বরদীর শাহীন বই বিক্রি ও যাত্রীদের বিনা পয়সায় বই পড়ার যে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তাতে চলন্ত ট্রেনে দুরপাল্লার যাত্রীরা একদিকে ভালো সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন অন্যদিকে শাহীনের কারনে ট্রেনের মধ্যে জ্ঞান চর্চারও ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আমরা রেলওয়ের পক্ষ থেকে তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছি।