চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম সমস্যা ও সম্ভাবনা

আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৩, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু:


আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এবছর আমগাছগুলো গুটিতে গুটিতে ছেয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ বলছে এবার চ্াপাইনবাবগঞ্জের আমবাগানগুলো প্রায় একশত ভাগ মুকুলিত হয়েছে। হরমোন স্প্রে করা গাছে ও পরিচর্যা করা বাগানে যেমন মুকুল ধরছে তেমনি স্প্রেহীন ও পরিচর্যাহীন বাগানে একই সমান মুকুল ধরেছে। আমের জন্য একটি ব্যতিক্রমি বছর বলা যায়। মুকুলের সমারোহ যেমন আমচাষী ও আম ব্যবসায়ীদের ভীষই আশান্বিত ও আনন্দিত করেছে তেমনি আশঙ্কিত করেছে বেশি উৎপাদন, দাম কম’ এই বিষয়টি। কৃষি বিভাগ বলছে অনুকুল আবহাওয়া বিরাজ করলে এবং কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ৩৭ হাজার ৮০০ হেক্টর আমবাগান থেকে সর্বোচ্চ ৬ লাখ মে. টন আম উৎপাদিত হতে পারে । যার মুল্য হবে ৭/৮ হাজার কোটি টাকা।

এমন সম্ভাবনা ও আশংকা সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এসোসিয়েশন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণা কেন্দ্রে সম্প্রতি ‘অবহেলিত আম শিল্প ও আগামীর সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সেখানে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, আম গবেষণা কেন্দ্র, উদ্যানতত্ব বিভাগ এর কর্মকর্তাগণ, চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিগণ, আমচাষী ও আম রপ্তানিকারকগণ এবং জেলার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মিগণ উপস্থিত ছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম নিয়ে মুক্ত আলোচনায় প্রত্যেকেই মন উজাড় করে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তবে সকলের কাছ থেকে সমস্যার কথাই প্রকাশ পেয়েছে। কোন পক্ষই জেলার আমের উন্নয়ন নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এমনকি কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাগণও। তবে আগামীতে আমের সম্ভাবনার কথা বলেছেন কেউ কেউ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ইতিহাস দীর্ঘ কয়েকশ বছরের পুরনো। শুধু তাই নয়, স্বাদে গন্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ঈর্ষনীয় সুনাম রয়েছে। আম উৎপাদনের ক্ষেত্রেও যে কোন জেলার চেয়ে বেশি এবং দেশের মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ এখানে উৎপাদিত হয়। তথাপি সময়ের সাথে সাথে এবং কৃষি প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তৃতির পাশাপাশি আমের প্রার্থিত উন্নয়ন হয়নি। আমবাগান এলাকা ও আম উৎপাদন নিয়ে গত ২০ বছরে কোন সার্ভে হয়নি। অনুমানভিত্তিক পরিসংখ্যান নিয়ে চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। যে কারণে এ নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেছে। কৃষি বিভাগ বলছে আমবাগান এলাকা ৩৭ হাজার ৮০০ হেক্টর এবং উৎপাদন ৫/৬ লাখ টন। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এসোসিয়েসনের বর্তমান জরিপ থেকে জানা যায় আমবাগান এলাকা প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর এবং আম উৎপাদন হয় প্রায় ১২ লাখ ৬০ হাজার মে. টন। আমগাছের চাষ এবং উৎপাদন বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কোন প্রশিক্ষণ হয়না। পূর্বের বর বড় গাছের আমবাগান আর বর্তমানের হাইব্রিড ছোট ছোট গাছের উৎপাদন বিতর্কে বড় গাছগুলো কেটে ফেলার প্রবণতা দেখা দেওয়ায় ওই জাতগুলো হারিয়ে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে সঠিক পরামর্শের অভাব রয়েছে। আমের জন্য খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩৫ বছর পূর্বে শুধুমাত্র আমের মান ও জাতের উন্নয়নের জন্য আম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে আঁতুর ঘরেই তার মৃত্যু হয়। আমলাতান্ত্রিক প্রভাবে জন্ম হয় ফল গবেষণা কেদ্র। এতে আম গবেষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়। তাই আজও চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী ওই নতুন নামকরণ মেনে নিতে পারেনি। সরকারি কর্মকর্তা বা মন্ত্রী এলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। আম গবেষণায় নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে শঙ্করায়নের মাধ্যমে। এতে দেশি যে জাতটি ব্যবহার করা হচ্ছে তার নাম মুছে দিয়ে বারি-১ বারি-২ নাম ব্যবহার করে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। অথচ ওই জাতগুলি চাঁপাইনবাবগঞ্জকে প্রতিনিধিত্ব করে। রপ্তানিযোগ্য ভাল জাতের আম উৎপাদনে সাম্প্রতিককালে কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও রপ্তানি ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য এখানে প্যাকেজিং হাউস নির্মার্ণের দাবী বার বার উত্থাপন করা হলেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছেনা। এদিকে রপ্তানির সাথে যুক্ত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, কোয়ারেন্টাইন, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, গবেষণা বিভাগ এর মধ্যে সমন্বয়ের তীব্র অভাব। আর হয়রান হচ্ছে রপ্তানিকারকেরা। যে কারণে বিশ্ব বাজারে আম রপ্তানি হচ্ছেনা। যেটুকু হয় তা ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে। সেখানেও প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। বিশেষত আম পরীক্ষার জন্য কোয়ারেন্টিনে পাঠালে তার ফলাফল যথাসময়ে আসেনা। তখন আম রপ্তানিযোগ্য থাকেনা। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রপ্তানিকারকেরা। রপ্তানিকারকরা এ ব্যাপারে গত দশ বছর ধরে সবমহলেই দেন দরবার করে আসছে। কিন্তু যেমন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়না তেমনি সরকারি কর্মকর্তারাও সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনা। ফলে রপ্তানিযোগ্য আমের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে উঠছেনা। এতে করে রপ্তানি থেকে যে রাজস্ব পাওয়ার কথা সেটা যেমন সরকার পাচ্ছেনা তেমনি রপ্তানিকারকরা বাধ্য হয়ে রপ্তানিযোগ্য আম দেশীয় বাজারে অর্ধেক দামে বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি অনেক আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে বিশ্ব বাজারে জেলার আমের সম্প্রসারণ ও জাত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আম বোর্ড বা টাস্কফোর্স গঠন করার দাবী জানিয়েছে। একইসাথে তারা ভারত থেকে আম আমদানি বন্ধ করার দাবী জানিয়েছে। মার্কেটিং বিভাগ আমের বাজার খোঁজার জন্য কাজ করছেনা। এ অভিযোগ কৃষি বিভাগের। রপ্তানিযোগ্য আম প্রকল্প হবার কথা শোনা যাচ্ছে কিন্তু বাস্তবে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। সারাদেশের জন্য এক ও অভিন্ন আম নীতিমালা হবে বলে ও শোনা গেল তারও কোন হদিস পাওয়া যায়না।

আম সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প আজ ও এখানে গড়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে সভা সেমিনারে বর বড় পরামর্শ শোনা যায় কিন্তু তা বাস্তবায়নে যে সুযোগ সুবিধা দেওয়া দরকার বিশেষত প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি পর্যায়ে বড় আকারে আম নিয়ে যে শিল্প রয়েছে সেখানে আমের পাল্প ও জুস ছাড়া অন্য কোন কিছু উৎপাদন হয়না। কিন্তু কিছু শিক্ষিত যুবক যুবতি প্রশিক্ষণ পেলে তারা নিজ অর্থায়নেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাড়িতে বাড়িতে আমচুর, আমতা, আচার, জেলি সহ বিভিন্ন আমজাত পণ্য উৎপাদন হতে পারে ও স্বাবলম্বি হতে পারে। তবে সেগুলো যেন সহজে রপ্তানি করা যায় সে ব্যাপারে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এসোসিয়েসন আম প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সেটা গোটা জেলায় সম্প্রসারিত করতে পারলে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে তারা দাবী করছে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জন্য আনন্দের খবর হচ্ছে, ইতোমধ্যে জেলার ৪ টি আম জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রায় চার বছর আগে পেয়েছিল ক্ষিরসাপাত আমের। এরপর ফজলি আমের স্বীকৃতি রাজশাহী জেলা কোনভাবে আদায় করলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি এসোসিয়েসনের মাধ্যমে মামলা করে ফজলি আমের স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনে। আর অতি সম্প্রতি ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আমের জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে আবেদন করার তিন বছর পরে। স্বীকৃতি প্রাপ্ত এ আমগুলোর মান আরও উন্নত করা যায় সে ব্যাপারে গবেষণা বিভাগের গবেষণা জরুরি এবং একইসাথে এ জাতগুলোর রপ্তানির ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ভুমিকা প্রয়োজন ।
লেখক : সাংবাদিক