চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমবাজারে ঢলনই শেষ কথা!

আপডেট: জুন ১৬, ২০২৫, ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কানসাট আমবাজার । ফাইল ছবি/সংগৃহীত

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:


চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত দুই সপ্তাহ ধরে আমচাষী ও আড়ৎদারগন বেশ বিপাকে পড়েছিল। কতিপয় আমচাষী আড়ৎদার এর উপর ৪০ কেজি মণ দরে আম কেনার পক্ষে মতামত দেন। এ বিষয়ে কানসাট আমবাজারে দফায় দফায় মিটিং করেন। একমত হতে না পারায় জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় কমিশনার এর দারস্থ হন। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার এর কার্যালয়ে সিদ্ধান্ত হয় কেজি দরে আম বিক্রি করতে হবে। এমতাবস্থায় আড়ৎদারগণ আম কেনা বন্ধ করে দেন। শেষমেশ আমচাষী ও আড়ৎদারগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন আম বিক্রিতে ঢলনই শেষ কথা, কমিশন পদ্ধতিতে অসন্তুষ্ট চাষিরা বাধ্য হয়ে ঢলনে বিক্রি শুরু করেছেন।

জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আমবাজারে দীর্ঘদিন ধরে ‘ঢলন’ প্রথা অনুযায়ী ৪০ কেজির পরিবর্তে অতিরিক্ত ওজনে আমের মণ নির্ধারিত হয়ে আসছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিমণ ছিল ৪৫ কেজি। ২০১৬ সালে ডিজিটাল স্কেল চালুর পর তা বেড়ে হয় ৪৬ কেজি। এরপর বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ ও প্রশাসনিক উদ্যোগের মাঝেও মণের ওজন ক্রমেই বেড়েছে-২০১৮ সালে ৪৮ কেজি, ২০২০ সালে ৫০ কেজি, ২০২৩ সালে ৫২ কেজি এবং ২০২৪ সালের শেষ দিকে তা দাঁড়ায় ৫৪ কেজিতে। জেলার রহনপুর ও ভোলাহাট আমবাজারে মণ আরও বেশি ৫৫-৫৬ কেজিতে নির্ধারণ করা হয়।

কাঁচামালের ঢলন প্রথা বাতিলের দাবির প্রেক্ষিতে, আমের মণে ৫২-৫৪ কেজির ওজন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তিনদিন পর আড়ৎদাররা কেজিপ্রতি ৩ টাকা কমিশন চাইলে নতুন করে জটিলতা দেখা দেয়। পরে ১১ জুন চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারদের সমন্বয়ে বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে ঢলন বাদ দিয়ে কেজিপ্রতি দেড় টাকা বা প্রতি মণে ৬০ টাকা কমিশনের সিদ্ধান্ত হয়।

কিন্তু পরদিন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় কানসাট আমবাজার ঘুরে দেখা যায়, সবই চলছে আগের মতো। এখনো ঢলন অনুযায়ী আম বিক্রি হচ্ছে। নেয়া হচ্ছে ৫২-৫৪ কেজি মণ হিসাব ধরে।

কানসাট আমবাজারের আড়ৎদার সৈয়দ আলী বলেন, আমরা তো কমিশনে কেজি দরেই আম নিতে চাইছি কিন্ত চাষীরা নিজ থেকেই ৫২-৫৪ কেজি হিসেবে আম দিয়ে যাচ্ছেন। এতে আমাদের তো কিছু করার নেই।
চাষীরা বলছেন- কেজি দরে আম নিতে আড়ৎদাররা হিসেবে কারচুপি করছেন, তাই কেজি দরেই আম দিচ্ছি।

শ্যামপুর এলাকার আমচাষি ইউসুফ আলী খাতাকলমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, মণপ্রতি দাম ২ হাজার টাকা। কেজি দরে বিক্রি করতে গেলে আড়তদাররা ২ হাজার টাকা ৫৪ দিয়ে ভাগ করে প্রতি কেজি ৩৭ টাকা ধরেন। ফলে ৪০ কেজির আমের মূল্য হয় ১,৪৮০ টাকা। এখান থেকে ৬০ টাকা কমিশন কেটে চাষি পান ১,৪২০ টাকা।
তিনি অভিযোগ করেন, যে হিসেবেই বিক্রি করি না কেন, চাষিরাই ঠকছে। আর ঢলন বাতিল নিয়ে আন্দোলনের পেছনে কিছু নেতা আছেন যারা আসলে চাষিদের স্বার্থ নয়, নিজেদের স্বার্থ দেখছেন। ইউসুফ আলী প্রকৃত চাষিদের নিয়ে ‘আম চাষি সমিতি’ গঠনের দাবি জানান।

আরেক চাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, ৭ মণ খিরসাপাত এনেছিলাম। কেজিতে দিলে আরও লস, তাই ৫৪ কেজিতে দিয়েছি। দাম পেয়েছি ২,৮০০ টাকা।
উমরপুর এলাকার সোহেল আহমেদ বলেন, আমি কেজি নাকি মণে বিক্রি করব, এটা একান্ত আমার বিষয়। আমি যেটাতে লাভবান হব, সেটাতেই বিক্রি করব।
এক আম ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসনকে জড়ানো ভুল সিদ্ধান্ত। তারা ৪০ কেজির বাইরে যেতে পারবে না। আমার মতে ৪৫ কেজিতে মণ হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, আমের ওজন নির্ধারণে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মতামত নেওয়া উচিত ছিল।

খিরসাপাত আম রপ্তানিকারকদের এক ব্যবসায়ী ঢলন বাতিলের পক্ষে থাকা কয়েকজনকে দায়ী করে বলেন, তারা নিজেদের স্বার্থে দেশি-বিদেশি অনুদান নিতে ‘আমনেতা’ সেজেছেন। এরা প্রান্তিক চাষিদের জন্য ক্ষতিকর।

মোবারকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদ হায়দারি বলেন, ৪০ কেজিতে মণ বাস্তবায়ন কঠিন। আমি ৪৫ কেজির পক্ষেই ছিলাম, কিন্তু কিছু লোককে বোঝাতে না পারায় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে।
শিবগঞ্জ উপজেলা আম আড়ৎদার সমিতির সভাপতি আবু তালেব বলেন, ক্রেতা ও বিক্রেতা যা ভালো মনে করবেন আম ব্যবসায়ে সেটাই হওয়া উচিৎ। কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, আম বিক্রিতে কেজি দরে কমিশন পদ্ধতি চাষিদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পুরাতন আমবাজারে কেজি দরে আম বিক্রি হয়ে থাকে। আম ব্যাবসায়ী নিখিল জানান, প্রতিদিন তিনি কানসাট আমবাজার থেকে ঢলনে আম কিনে কেজি দরে আম বিক্রি করেন। তিনি আরো বলেন, কানসাট আমবাজার থেকে কেনা আম বিক্রির সময় ওজন কমে যায়। কাজেই ঢলনই শেষ কথা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশাররফ হোসেন জানান, ঢলন বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যম থেকেই জেনেছি।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজাহার আলী বলেন, ৪০ কেজিতে মণ ও কেজিপ্রতি দেড় টাকা কমিশনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ সিদ্ধান্ত সব জেলায় কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন বলেন, আমের ওজন নিয়ে অরাজকতা বহুদিনের। পচনশীল ফল হওয়ায় দৈনিক ৪০ কেজিতে ১-১.৫ কেজি পর্যন্ত ওজন কমে যায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ৪২-৪৫ কেজিতে মণ নির্ধারণ করলে বাস্তবায়ন সহজ হতো এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও হতো।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Exit mobile version