চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি ও মো. ফারুকুর রহমান ফয়সাল

আপডেট: মে ১৬, ২০২৩, ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু:


আম, রেশম লাক্ষা, কাঁসা ও গম্ভীরা সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ বহু ইতিহাস ঐতিহ্যে যেমন ভরপুর তেমনি ইদ্রিস আহমেদ মিয়া, প্রফেসর এমাজুদ্দিন, মনিরুজ্জামান মিয়া, মাইনুর রেজা চৌধুরী, আব্দুল হক, রফিকুন্নবী, মমতাজউদ্দিন, গোলাম আরিফ টিপু সহ অসংখ্য জ্ঞানী গুণিজনদের পূণ্যভূমি। পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদী বিধৌত এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিল্প সংস্কৃতির বহু পুরানো লীলাভূমি। গম্ভীরা গান, কবি গান, আলকাপ গান, জারি গান, মেয়েলি গীত, পুঁথি পাঠ, বাউল গান, বিয়ের গান, লোক সঙ্গীত, গীতি নাট্য, বৈঠকি গান, দোলযাত্র্ ানাটক, চারু ও কারু শিল্পসহ অসংখ্য সংস্কৃতির তীর্থস্থান এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গম্ভীরা ছাড়া উল্লিখিত সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছেনা। অনেকগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলোকে উজ্জীবিত করার জন্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে তীব্রভাবে।

স্বাধীনতার বছর দুয়েক আগে কৃষি তথ্য কর্মকর্তা ও নাট্যকার কুতুবুল আলম এবং রকিবুল ইসলাম জুটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানের পুনঃচর্চা শুরু করেন। নানা নাতির অনবদ্য অভিনয়, সামাজিক ত্রুটি বিচ্যুতির খোলামেলা ও হাস্য রসের মাধ্যমে উপস্থাপনা এবং সেইসাথে কৃষকের অভিনব সাজ দর্শকদের মুগ্ধ করে। কিন্তু স্বাধীনতার ডামাডোলে প্রায় দেড় বছরের জন্য পিছিয়ে যায়। তারপর আবার শুরু হয়। ভাগ্যক্রমে নাটোর উত্তরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে তাদের গম্ভীরা প্রদর্শনের সুযোগ ঘটে সেদিন তাদের অভুতপুর্ব গম্ভীরা পরিবেশনা প্রধানমন্ত্রীকে মুগ্ধ করে। প্রধানমন্ত্রী নানা নাতিকে কন্ঠলগ্ন করে সর্বোতভাবে সহযোগীিা ও পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস প্রদান করেন। এর ফলে তারা টিভিতে গম্ভীরা প্রদর্শনের সুযোগ পান, পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় তারা আমন্ত্রিত হতে থাকেন। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষাসহ এ সংস্কৃতি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। তাঁদের মৃত্যুর পর জেলায় অন্ততপক্ষে ১০/১২ টি গম্ভীরা দল সৃষ্টি হয়েছে। তারাও টিভিতে প্রদর্শনসহ বিভিন্ন জেলায় আমন্ত্রিত হন। গম্ভীরা আজ সারা দেশের জন্য একটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি। গম্ভীরা এখন বিশ্ব হেরিটেজের স্বীকৃতি পাবার অপেক্ষায় রয়েছে। গম্ভীরার মত এমন সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জেলার অন্যান্য সংস্কৃতিও আলোর মুখ দেখতে পারে।

প্রতিদিন মানূষের জীবন সংগ্রাম কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ফলে সাংস্কৃতিক বিনোদন চর্চা মানুষকে আর দোলা দেয়না। তারপরেও এসকল সংস্কৃতি চর্চা যদি সচল থাকতো তাহলে মানুষ কোনো না কোনোভাবে বিনোদনে অংশ গ্রহণ করতো। কারণ বাঙালি জাতি হিসেবেই বিনোদনপ্রিয়। সংস্কৃতির এমন দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান কালচারাল অফিসার মো. ফারুকুর রহমান ফয়সাল। যদিও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যম-িত সকল সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে প্রাপ্ত অপ্রতুল অর্থ দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে এসে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তথাপি তার চেষ্টায় কোনো ফাঁক নেই। ২০১৫ সাল থেকে অদ্যবধি তিনি এ ব্যাপারে নিরলস ও আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার লেখাপড়ার বিষয় ও কর্মক্ষেত্রের বিষয় নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত বলেই সম্ভবত তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে গতিশীল করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন নাট্যকলায় এবং পিএইচডি করেছেন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বিনির্মাণ ও বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অন্যদিকে চাকরি পেয়েছেন কালচারাল অফিসার হিসেবে। এ চাকরিতে তিনি তৃপ্ত বলে স্বীকার করেন যদিও অন্য চাকরিতে যাওয়ার সুযোগ ছিল তার।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র, জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলা সমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করিবেন যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবার ও অংশগ্রহণ করবার সুযোগ লাভ করতে পারেন। এরই প্রেক্ষিতে শিল্পকলা একাডেমি নামে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। সংবিধানে বর্ণিত নীতিমালা ও শিল্পকলা একাডেমির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংস্কৃতিক সকল বিষয় পুরোপুরি জনসম্পৃক্ত। এখানেই কালচারাল অফিসার কতটা জনসম্পৃক্ত হতে পারেন সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সেক্ষেত্রে ফারুকুর রহমান ফয়সালের আন্তরিকতার অভাব দেখা যায় না। তিনি প্রথম থেকেই জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ রক্ষাতো করেনই তারপরেও সে সব সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তির কাছে সরাসরি সশরীরে উপস্থিত হন বারবার এবং তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা যাঁচাই করে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। তারই প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালে ৫ দিন ব্যাপী গম্ভীরা ও আলকাপ গানের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২০ টি দলের প্রায় ২০০ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। মৃতপ্রায় বাউল গান ও আলকাপ গানের নিষ্ক্রিয় শিল্পীদের খুঁজে খুঁজে বের করেন তাদের সক্রিয় করে দল পুনর্গঠন করেন। বাউল শিল্পীদের নিয়ে বাউল কুঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। এখন গোবরাতলায় নিয়মিত বাউল গানের আসর হয়। তেমনি আলকাপ শিল্পীদের কয়েকটি দল গঠন করেন। বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনকে অনুষ্ঠান করার জন্য একাডেমির কক্ষসহ অডিটোরিয়াম ব্যবহার করার সুযোগ করে দেন বিনা ভাড়ায়। যেন জেলার এ সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক কর্মকা- সচল ও গতিশীল রাখতে পারে।

জনগণ অবহিত হতে পারে ও অংশগ্রহণ করতে পারে। উল্লিখিত এ সকল কাজ তিনি না করলেও কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবেনা। শুধু তাই নয়, তিনি সকলকেই হাশিমুখে গ্রহণ করতে পারেন। ছোট বড়, শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল সংস্কৃতিমনা মানুষ নিঃসংকোচে তার সাথে মিশতে পাওে, ভাব বিনিময় করতে পারে। তিনি যেমন সংস্কৃতমনা তেমনি ভাল বক্তা এবং সমালোচক। তার লেখা ৪ টি নাটক ‘ভূত কেত্তন’, ‘কাল’ ,’সিঁড়ি’, ও ‘গৌড়’ ৭১ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রদর্শিত হয়েছে এবং সুনাম কুড়িয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ টি ম্যাগাজিন ও ২টি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে তারই তত্ত্বাবধানে।
২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত আমি জেলা শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলাম। তখন নির্ধারিত ৬টি বিষয়, নাট্যকলা, নৃত্যকলা, চারুকলা, আবৃত্তি ও তবলা প্রশিক্ষণ দিতেন ৬ জন প্রশিক্ষক। আর জাতীয় দিবস সহ রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তি পালন করা ছাড়া কোনো কাজ ছিলনা। যা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে একজন সহকারি কমিশনার দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু বর্তমানে একাডেমির কাজ কয়েকগুণ বিস্তৃত হয়েছে।

এখন উল্লিখিত ৬টি বিষয়ে ১০ জন প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ দেন, গত ৫/৬ বছরে ৪৯ জন গুণিজনকে ৭ টি ক্ষেত্রে সম্মাননা সহ নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ৬৬ দিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১০ টি নতুন গান নির্মিত হয়েছে, তৃতীয়বারের মত এক্রোবেটিক শো প্রদর্শিত হয়েছে, করোনাকালীন ১৫২ জন শিল্পীকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা ও খাদ্য সয়হতা দেওয়া হয়েছে, প্রতি বছর নতুন করে ১০ টি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে ৪০ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির মধ্যে সাঁতাল, ওঁরাও হিজড়া সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ৩০০ মানুষকে তাদের সংস্কৃতি প্রদর্শন করার সুযোগ দান সহ আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, শুদ্ধভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য প্রায় ১৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এই ৫/৬ বছরে একাডেমি মঞ্চে ৮টি নাটক, ১টি যাত্রা, ১টি ছায়ানাট্য, ২টি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে, এ ছাড়া সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৩০০ টি অনুষ্ঠান প্রদর্শিত হয়েছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই একাডেমি প্রাঙ্গণে সংস্কৃতপ্রেমী দর্শক শ্রোতাদের আগমনে মুখরিত দেখা যায়। সমগ্র দেশে সংস্কৃতির বিকাশের জন্য অন্যান্য জেলায় এমন ফারুকুর রহমান ফয়সাল দরকার তেমনি এই খাতে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ সঠিকপথে ব্যয় হচ্ছে কিনা তা মনিটর করা দরকার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির বিশাল ত্রিতল ভবন। এর একতলা এবং দোতালাতে একাডেমির কাজ হয়। কিন্তু ত্রিতল ভবনটির ৫/৬ টি কক্ষ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই সম্ভাবনাময় ও গতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনকে অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিতে পারেন। এতে যেমন সেই ভবনটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, তেমনি অব্যাবহৃত থেকে নষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক : সাংবাদিক