চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে আধুনিক ভবন, নেই সেবার দেওয়ার সক্ষমতা!

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫, ৯:১৪ অপরাহ্ণ

সাজেদুল হক সাজু, চাঁপাইনবাবগঞ্জ


চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালটি নানামুখী সংকটে থাকায় কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। সরকারি এই হাসপাতালে আছে ডাক্তার পর্যাপ্ত জনবলের সংকট। এর মধ্যে ২৫০ জন রোগীর খাবার সরবরাহের চাহিদা থাকলেও খাবার পাচ্ছেন মাত্র ১০০ জন রোগী।

২০২২ সালে খাবার (পথ্য) চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন না পাওয়া সব রোগীকে খাবার দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালটি রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে পদ সৃজনে মঞ্জুর হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ২৫০ শয্যার জনবল পাওয়া যায়নি। এরফলে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে ভিড় করেন। এইসব রোগীর চিকিৎসা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। অন্যদিকে সবমিলিয়ে গড়ে প্রায় তিন শতাধিক রোগী ভর্তি থাকছে প্রতিদিন।

হাসপাতাল সূত্র থেকে জানা যায়, ১০০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতালের পরিবর্তে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের রোগীর পথ্য সরবরাহ ও প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি না পাওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেই চিঠির কোনো সুরাহা করতে পারেনি। পরে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর পত্র দেয়া হয়; কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে জেলা হাসপাতালটিতে গাইনি ও প্রসূতি সেবা, নবজাতক ও শিশু সেবা, ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনা, দন্ত চিকিৎসা, চক্ষু সেবা, নাক-কান-গলা, অপারেশন সার্ভিস (সার্জারি, অর্থপেডিক, গাইনি, নাক কান গলা, চক্ষু ও দন্ত) সেবা চালু আছে। এছাড়াও বহির্বিভাগ ও জরুরি সেবা, মেডিসিন, এএনসি ও পিএনসি ও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, জলাতঙ্ক ভ্যাকসিনেশান কর্নার, ল্যাব সার্ভিস, এক্সরে সার্ভিস ও আলট্রাসোনোগ্রাফি সার্ভিস চালু রয়েছে। এছাড়া এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর মোট মঞ্জুরিকৃত পদ হচ্ছে ৩৭৭টি। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালকসহ কর্মরত আছেন ২৫৯ জন এবং ১১৫ টি পদে কোনো জনবল নেই।

চিকিৎকদের শূন্য পদগুলোর মধ্যে রয়েছে, সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি অ্যান্ড অবস), সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো-সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট নেই (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন)। এই পদগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলাবাসী।

সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জরুরি বিভাগসহ আউটডোরে রোগীদের ভিড়। হাসপাতালের নতুন ভবনে চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন সেবা নিতে আসা শতশত সাধারণ মানুষ। পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যায় বেশি। হাসপাতালের ফার্মেসির সামনেও ওষুধ নেয়ার জন্য কয়েকটি লাইন দেখা যায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আতাহার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলিম বলেন, হাসপাতালে সেবা ও চিকিৎসা ভালো পাচ্ছি। তবে খাবার পাচ্ছি না, খাবারের পেলে আরও ভালো হয়। তাই সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছি সরকার যেন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে।

এজাজ আহমেদ নামে আরেকজন বলেন, আমার মেয়ের ডায়রিয়া হয়েছিল। গত শনিবার থেকে হাসপাতালে ভর্তি আছি। চিকিৎসা ভালো চলছে। তবে এখানে খাবারদাবারের কোন ব্যাবস্থা নেয়। বাইরে থেকে কিনে খাচ্ছি। এতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এখানে খাবার দিলে কিছুটা ভালো হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার গোলাপ চেয়ারম্যান হাটের বাসিন্দা আনোয়ার জানান, আমি পেট ব্যাথা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসাপাতালে ভর্তি আছি। এখানে খাবার ও ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়মিতই পাচ্ছি। এছাড়া সিস্টারদেরকে ডাকলে তারা দ্রুত ও গুরুত্বসহকারে আমদের চিকিৎসা দিয়ে থাকছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা টুনু মিয়া বলেন, হার্ডের সমস্যা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি আছি। এখানে আমার সেবা-যত্ন ঠিক হচ্ছে। তবে খাবার দাবার পাচ্ছি না, তাই অসুবিধা হচ্ছে। তাই হাসপাতালে আমাদের খাবারের জন্য কিছু ব্যাবস্থা করে।

তামিম ইকবাল নামে আরেকজন বলেন, দুইদিন আগে থেকে ভর্তি আছি। জ্বর আর বর্মি নিয়ে ভর্তি হয়েছি। এখানে চিকিৎসা সেবার মান যথেষ্ট ভালো এবং খাবার দাবারও পাওয়া যাচ্ছে।

২৫০ শয্যা বিশিষ্ঠ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতাল এর তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাসুদ পারভেজ বলেন, আমাদের এখানে ২৫০ শয্যার জনবল আছে। কিন্ত আমরা যে ডায়েট (খাবার) টা দিই তা আমরা ১০০ শয্যার খাবার দিতে পারি কারন ২৫০ শয্যার হাসপাতালের অর্থনৈতিক কোড ২১০ কিন্ত বর্তমানে আমরা ২১১ কোডে আছি। তাই আমাদের হাসপাতালের অর্থনৈতিক কোড ২১০ হলে আমরা রোগিকে ডায়েট দিতে পারবো।

আর ২১০ কোড পাওয়ার জন্য লিখিত আবেদন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফাইন্যান্স ডিভিশনে পাঠিয়েছি। তারপর তারা কিছু বিষয় আমাদের ইনকোয়ারি দেয় এবং ইনকোয়ারি গুলোর উত্তর আমরা দিয়েছি কিন্ত এখন পর্যন্ত আমরা তার সমাধান পায়নি। এছাড়া অর্থ বিভাগের সাথে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা আমাদের সমাধান করে দিবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু জনবল ছিলো। তাদের প্রজেক্টের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন মাসের দিকে শেষ হয়ে যায়। যে কারণে আমরা তাদেরকে চাকরিতে রাখতে পারছিনা। কারণ তাদের বেতন বরাদ্দ আসবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। সেইকারণে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবলের একটা সংকটের মধ্যে আছি।

তবে আমাদের জনবলের একটি চাহিদা দেওয়া আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রাণলয়ে। এই জনবলের চাহিদাটা যদি আমরা অনুমোদন পায় তাহলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবলের যে ক্রাইসিস আছে সেটা পূরণ করতে পারবো। আর ডাক্তারদের যে বিষয়টি, আমাদের এখানে ২৫০ শয্যার জনবলই আছে। তবে ইতিমধ্যে কিছু ডাক্তার বদলিজনিত কারণে চলে যাওয়ার ফলে ডাক্তারদের নিয়ে কিছুটা সংকটের মধ্যে আছি। আশা করছি এটা খুব দ্রুতই রিকোভার করতে পারবো।