চামড়ায় এবারও সিন্ডিকেট ! ‘লাম্পি স্কিন’ দাবি করে দাম কমানো হয়েছে

আপডেট: জুন ১৫, ২০২৫, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:


দেশে বেশ কয়েক বছর থেকে সক্রিয় আছে চামড়া সিন্ডিকেট। বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিবছর দাম কমানো হয়েছে চামড়া। এবার সরকার থেকে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে লোকসান গুনেছেন। সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে সরকারের নির্দেশনাকেও তারা রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ফলে লোকসানের বোঝাটা নিতে হয়েছে তাদের ঘাড়েই।

বরাবরের মতো এবারও রাজশাহীর চামড়া সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন ছলাকৌশল করে চামড়ার দামে পতন ঘটিয়েছে। এবার অজুহাত চামড়ার পাইকার ও আড়ৎদাররা গরুর ‘লাম্পি স্কিন’ রোগ আবার অ্যানথাক্স বলে দাবি করেছেন। অনেক ব্যবসায়ী চামড়ার মান খারাপ বলেও দাবি করেছেন। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অসুস্থ কোরবানির পশু বিক্রির সুযোগ নেই। হাট বা খামারে বিক্রি হয়নি এধরনের গরু। আর অসুস্থ গরু কোরবানিও হবে না।

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, কোরবানির জন্য নিখুঁত পশুর প্রয়োজন। পশুকেও হতে হবে সুস্থ। এছাড়াও পশুর দৃষ্টি, হাঁটাচলাও পরীক্ষা করতে হয়। এ ধরনের পশু কোরবানি হলে কবুল হয়। অসুস্থ পশু কোরবানি দেওয়া জায়েজ না।

এ বছর সরকার চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছে। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামের প্রভাব বাস্তবে লক্ষ্য করা যায়নি। বরাবরের মতো সেই সিন্ডিকেটই সক্রিয় থেকে তাদের ইচ্ছামতো চামড়ার দামের পতন ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে চামড়া বিক্রি হয়েছে অর্ধেক দামে। আর এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন রাজশাহী জেলা ও মহানগরের তিন হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী।

গেল ২৬ মে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। এ ছাড়া সর্বনি¤œ কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ছাগল অথবা ভেড়ার চামড়ার দাম পাওয়া যায়নি। অনেকে এই চামড়া নদী ও পুকুরে ফেলেছেন।

মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, গেল দুই বছরের তুলনায় এবার বাজার খুব বাজে গেছে। চামড়া কেনা হয়েছে ৮০০ থেকে হাজার টাকায়। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে ৫০০ টাকাও দাম পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লবণ, শ্রমিক, খরচ সব মিলিয়ে সেই দাম ওঠে না। উল্টো আরও লোকসান হয়। শুধু দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না। দর ঠিকভাবে বাস্তবায়ন, বাজার মনিটরিং, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহায়তার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। না হলে প্রতি বছরই চামড়ার দাম কমবে।

রাজশাহী জেলায় কোরবানি হয়েছে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৬টি পশু। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে এ বছর কোরবানির দুই লাখ ৮৭ হাজার ৫২৪টি গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরমধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া সংখ্যা এক লাখ ১০ হাজার ৯০৫টি। আর ছাগলের চামড়ার সংখ্যা এক লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯টি। জেলাগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে সংরক্ষণ করা চামড়ার সংখ্যা ৬৭ হাজার ২৪৭টি। নাটোরে ৫৩ হাজার ৫১৩টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৬ হাজার ৭৩৮টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। বগুড়ায় সংরক্ষণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৪৩৬টি চামড়া। পাবনায় সংরক্ষণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৯৮৪টি চামড়া। সিরাজগঞ্জে সংরক্ষণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ২২২টি চামড়া। নওগাঁয় সংরক্ষণ করা হয়েছে ২১ হাজার ২৭৩টি চামড়া। জয়পুরহাটে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৬ হাজার ১১১টি চামড়া।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এ বছর কোরবানির চামড়ার মূল্যবৃদ্ধি এবং এতিমদের হক আদায়ের উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের এতিমখানা, মসজিদ ও মাদরাসাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মেট্রিকটন লবণ সরবরাহ করা হয়। যাতে করে স্থানীয়ভাবে দুই থেকে তিন মাস চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য ৯৭ জন। তাদের অধীনে প্রায় ৩ হাজারের বেশি মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও মহানগরী ঘুরে চামড়া কিনেছেন। তবে এবার বেশিরভাগ চামড়া গেছে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোতে।

সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা রীতিমতো মাথায় হাত দিয়েছেন। তারা লাভের আশায় ব্যবসায় এসে উল্টো লোকসান গুনেছেন। কেউ কেউ হারিয়েছেন পুঁজি। পবার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মুস্তাক আহমেদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বেশি মূল্য নির্ধারণ করায় ৩০০ পিস চামড়া কিনেছি। যার অধিকাংশ ছোট গরুর চামড়া। এগুলো নিয়েছি ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়। ইদে সারাদিন ঘুরে ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করে বিকেলে বাজারে তোলার পর প্রথম ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা কেউ দাম জিজ্ঞাসাও করেনি। পরে গড়ে ৩৩০ টাকা করে সব বিক্রি করে দিয়েছি। এতে হিসাব করে দেখলাম লাভই হয়নি। উল্টো ৬০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। হতাশ হলাম। সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তাহলেই চামড়ার সুদিন ফিরবে।

মোহনপুর উপজেলার চামড়া ব্যবসায়ী আবদুর রউফ বলেন, আমি এবার দেড় হাজার চামড়া কিনেছি। আমার চামড়া কেনা হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। এগুলো সংরক্ষণ করে লবণ মাখিয়ে রাখা হয়েছে। রোগাক্রান্ত গরুর থাকতে পারে। তবে তা দেখা লাগবে। ট্যানারি মালিকরা কিভাবে দাম দেয় তাও দেখার বিষয়।
রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, আমি আপনাকে দেখাতে পারবো কতগুলো গরুর চামড়ায় ল্যাম্পি স্কিন আছে। সংগৃহীত ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট। তবুও আমরা রিস্ক নিয়ে এই চামড়া কিনেছি। এবার আমি নিজে সংগ্রহ করেছি সাড়ে ৭ হাজার চামড়া। আমরাও চাই না কারও লোকসান হোক। তিনি বলেন, আপনি আমার আড়তে আসলে এই চামড়াগুলো দেখাতে পারবো।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতোয়ার রহমান বলেন, রাজশাহীর কোন হাটে লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত গরু বিক্রি হয়নি। আর এই রোগও দৃশ্যমান। যেকোন মানুষ দেখলেই বুঝতে পারবেন গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত। গরুর চামড়ায় বিশাল আকৃতির ছোপ ছোপ দাগ দেখা যাবে। আর রোগ থাকলে সে পশু দিয়ে কোরবানি করাও সম্ভব না।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, চামড়া ব্যবসায়ীরা লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত বলে দাবি করছেন। কিন্তু তাদের কথা সঙ্গে মিল নেই। হাট বা খামারে এই ধরনের কোন গরু বিক্রির সুযোগ নেই। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেলে আমরা পরীক্ষা করে দেখবো।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ