চিনা রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর ।। সম্পর্কের এক নতুন যুগের সূচনা

আপডেট: অক্টোবর ১৫, ২০১৬, ১১:৫০ অপরাহ্ণ

চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। বাংলাদেশ চিনা রাষ্ট্রপতির এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক সফর’ হিসেবেই দেখছে। ১৯৮৬ সালের পর প্রথম কোনো চিনা রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর করলেন। এই সফর ভূ-রাজনৈতিক কারণেই যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ অন্যান্য দেশের মনোযোগ কেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ওইসব দেশ সফরের আদ্যপান্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আপাতভাবে বলা যায়, চিনা রাষ্ট্রপতির এই সফর বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশ লাভবানই হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই চিনা রাষ্ট্রপতির এই সফর দেশের সংবাদ মাধ্যম তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুত্ব পেয়েছে।
সফরকালে চিনা প্রেসিডেন্ট দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার মতৈক্যের কথা জানান এবং ‘উচ্চ পর্যায়ের মত বিনিময় ও কৌশলগত যোগাযোগে’ সম্মত হওয়ার কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও চিন ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু; ২০১৭ সাল হবে চিন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বছর। চিনা রাষ্ট্রপতির এই ঘোষণাও ঐতিহাসিক। সময়ের বিবেচনায় অনেক সময় অতীত খুবই গৌন হয়ে যায়। বিশ্ব বাস্তবতার সাথে মিশতে বা সমঝোতা করতে ব্যর্থ হলে প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকা যায় না। একাত্তরে চিনের ভূমিকা আমরা জানি- সে দেশটির সরকার কীভাবে পাক হানাদার বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে এ দেশের স্বাধীনার বিরুদ্ধে, এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহায়তা করেছিল। সময়ের পরিক্রমায় সেই দেশেরই রাষ্ট্রপতি মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গেলেন।
দু দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নয়নের যে মতৈক্য তা বাস্তবতার নিরীখে সত্যিকার অর্থেই এক ঐতিহাসিক অভিযাত্রা। বাস্তবতাটা এই যে, চিন এখন বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতির দেশ।
বাংলাদেশ এই সফরে কী পেল?- এমন প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। প্রত্যাশার মাপটা যতই বড় হোক না কেন- যা পেয়েছে তাও কম কিসের। উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও চিন। এর মধ্যে ১২টি ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক।
চিনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর যে লক্ষ্য বাংলাদেশের রয়েছে তা অর্জনে এটা ‘গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ’ নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগ তুলে ধরেন প্রেসিডেন্ট শি। এরপর থেকে এই উদ্যোগকে ঘিরেই চলছে দেশটির অর্থনৈতিক কূটনীতি।
শি জিনপিং বাংলাদেশকে চিনের ‘ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু ও ভালো অংশীদার’ অভিহিত করেন। এই তিনটি শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ- চিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হল। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ এক অসামান্য উচ্চতায় নিজেকে মেলে ধরতে পারছে। বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ সত্যিকার রূপ দিতে এ সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আমরা মনে করি। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব’-বঙ্গবন্ধুর এই নীতিতেই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সন্দেহ নেই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চিন এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। চিনা রাষ্ট্রপতির এই সফর বাংলাদেশের ভাবমূতি উজ্জ্বল করেছে, অন্যদিকে ব্যবসা-বণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের কূটনীতিতে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সক্ষমতা আগের যে কোনে সময়ের চেয়ে পরিপক্ক হয়েছে। তবে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যদিও বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এটাই প্রত্যাশিত। চিনের সাথে ভারত, কিংবা চিনের সাথে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়েই সম্পর্কে ভারসাম্যমূলক নীতি প্রয়োগের সক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে।