চিন-জো-কুকির ঐক্যের ডাক দিয়ে বিতর্কে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী

আপডেট: নভেম্বর ১৪, ২০২৪, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ


সোনার দেশ ডেস্ক :


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমার এক বক্তব্য ঘিরে হঠাৎ আলোচনা শুরু হয়েছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
মাস দুই আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরে ওই বক্তব্য দিলেও সম্প্রতি ভারতের স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমে সেটি প্রচারের পর থেকে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি জায়গায় লালদুহোমা ভারত, মিয়ানমার আর বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা চিন-জো-কুকি জনগোষ্ঠীর ঐক্যের ডাক দিয়ে বক্তব্য দেন। সেটির কিছু অংশ গোয়া ক্রনিকলে প্রচারের পর থেকেই আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লালদুহোমার বিরুদ্ধে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী এজেন্ডা’ ছাড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।

কী বলেছেন লালদুহোমা?
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা স্টেটের ইন্ডিয়ানাপোলিস শহরে প্রবাসী ভারতীয়দের এক অনুষ্ঠানে লালদুহোমা চিন-কুকি-জো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বলেন, বিশ্বাসের দিক দিয়ে তারা ঘনিষ্ঠ, তারা একই সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমানার কারণে তারা বিভক্ত।

তিনি বলেন, “আমি চাই, আমাদের সেই বিশ্বাস আর আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠুক যে, একদিন ঈশ্বরের কৃপায় আমরা এক নেতৃত্বের অধীনে আমাদের জাতীয়সত্তা গঠনের লক্ষ্যে উঠে দাঁড়াব। একটি দেশের সীমানা থাকে, কিন্তু একটি জাতি সেই সীমানা অতিক্রম করে।
“আমাদের অন্যায়ভাবে ভাগ করা হয়েছে। তিন দেশের তিন সরকারের অধীনে জোর করে রাখা হয়েছে। এই ধরনের কোনোকিছু আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না।”

লালদুহোমা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করেছি, তার প্রাথমিক কারণ হল আমাদের সকলের জন্য ঐক্যের পথ খোঁজা। আমরা এক মানুষ, ভাই ও বোনেরা, আমাদের মধ্যে বিভাজন হতে দিতে পারি না।”

ভারতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম নর্থ ইস্ট লাইভ লিখেছে, কুকি-জো জাতিগোষ্ঠী ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ফলে তিনি একই সাংস্কৃতিক আর ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘স্পষ্ট উসকানি’ দিয়েছেন। তিনি জোর দিয়েছেন, রাজনৈতিক সীমানার মাধ্যমে বিভক্ত হলেও চিন-কুকি-জো জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহাসিকভাবে ‘এক হওয়ার’ দাবি রয়েছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে অনুমান করা হচ্ছে, তিনি আলাদা কুকি-জো জাতিগোষ্ঠীর ধারণাকে সমর্থন দিচ্ছেন।

ইন্ডিয়ানাপোলিসে বক্তব্য দেওয়ার দুদিন আগে, অর্থাৎ গত ২ সেপ্টেম্বর মেরিল্যান্ডে ‘মিজো ডে’ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে লালদুহোমা আরও বিশদ বক্তব্য দেন। সেখানে জো জনগোষ্ঠীর অধীনে অনেক নৃগোষ্ঠীর জন্য সর্বসম্মত নামকরণ, তাদের অঞ্চলের ইতিহাস ও জাতিগুলোর মধ্যে সাধারণ আচার বা চর্চার উপায় নিয়ে কথা বলেন।

তিন দেশে ছড়িয়ে থাকা এই জাতিগুলো ভারতের মধ্যেই একত্র হতে পারে কিনা, সেটিও ভেবে দেখেছেন বলে জানান লালদুহোমা।
মেরিল্যান্ডে লালদুহোমা বলেন, “১৯৮৮ সালে জোরো আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের ভেতরে জো-দের পুনর্মিলন।

ভারত, বার্মা ও বাংলাদেশের জো মানুষেরা কি আজ পুনরায় একত্র হতে পারে? আমাদের সময়ের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালে এটা ভাবা কঠিন নয় যে, সেই পুনর্মিলন একদিন সম্ভব হবে। সম্ভবত ভবিষ্যতে ভাগ্যে সেই পুনর্মিলন রয়েছে। আর এই বিশাল দায়িত্ব সম্পর্কে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে আমি বেখেয়াল নই।

“এখনকার জন্য আমি কেবল বলতে পারি, আমি সেই দিন আর সময়ের জন্য অপক্ষায় আছি, যেদিন উপরের প্রশ্নের উত্তরগুলো মিলবে।ৃযেমন আপনারা সবাই জানেন, বার্মা, বাংলাদেশ ও মণিপুরের আমাদের ভাইবোনেরা তাদের নিরাপত্তার জন্য মিজোরামে আমাদের কাছে এসেছেন। বাস্তুচ্যুত ৪০ হাজার মানুষ আমাদের তত্ত্বাবধানে আছে।”

নর্থ ইস্ট লাইভ লিখেছে, কুকি-জোদের মধ্যে ঐক্যর বিষয়টি মিজোরামের প্রধান নির্বাচনি ইস্যু। যদিও সাধারণত তাদের নিয়ে আলাদা জাতি গঠনের বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হয় না।

লালদুহোমার বক্তব্যকে কেউ কেউ বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যের সঙ্গে মেলাচ্ছেন, যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাইরে একটি ‘আলাদা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গড়ার চক্রান্ত চলছে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের’।

চিন-কুকি-জো পুনর্মিলনের ধারণা কারা সমর্থন দেন
জো জাতিগোষ্ঠীর ‘পুনর্মিলন’ বা ‘সংগঠিত’ হওয়ার ক্ষেত্রে মিজোরামে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের বিষয়টিতে রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) আন্দোলনের যোগসূত্র রয়েছে।

দুই দশকের বিদ্রোহের পর এমএনএফ বিদ্রোহীদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৯৮০ সালের মিজো চুক্তিতে বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য জুড়ে মিজো-অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে একটি প্রশাসনিক ইউনিটে আনার কথা এমএনএফ প্রতিনিধিরা তুলেছিলেন। কিন্তু ভারত সরকার এ ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

মিজোরাম চুক্তির পর কোনো বিদ্রোহ না হলেও বিভিন্ন কুকি-জো বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার, মণিপুর ও বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে। তারা কুকি-জো অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে স্বায়ত্তশাসন চাইছে। কেউ আবার জোদের এলাকাগুলো একীকরণের দাবি তুলছে।

মিজো চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যে ‘জো-রিইউনিফিকেইশন অর্গানাইজেশন’ (জোরো) গঠনের মাধ্যমে তাদের পুনর্গঠনের ধারণা নতুন করে শুরু হয়েছে। নিজেদের ঐক্যের জন্য সংগঠনটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়েছে।

সক্রিয় এ সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আর সাংকাওইয়া বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমার বক্তব্য আর নীতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের নীতি হল ভারত, বার্মা ও বাংলাদেশে বসবাসকারী জোদের এক ছাতার নিচে আনা। কিন্তু এই পুনর্মিলনের জন্য আমাদের অস্ত্র হল ‘অহিংসা’…। আমরা সেটি যদি অর্জন করি, তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হল আমরা ভারত, বার্মা ও বাংলাদেশে যোগ দেব নাকি আলাদা একটি প্রশাসনে থাকব। সেই সিদ্ধান্ত থাকবে জনগণের হাতে।”

অন্যান্য সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন অঞ্চলের জোদের ঐক্যের বার্তা তুলে ধরেছে।
জোরো এর সহসভাপতি এবং লালদুহোমার জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেডপিএম) থেকে এমএলএ হওয়া লালমুয়ানপুইয়া পুন্তে বলেন, “সংবিধানে রাজ্যের সব রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ গোষ্ঠীর পুনর্মিলনের কথা বলা আছেৃ। সব চিন-কুকি-মিজো এই ধারণা ও মূলনীতিকে ধারণ করে।”
অন্যদের সঙ্গে লালদুহোমার দাবির পার্থক্য যেখানে

মিজোরাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জে ডুঞ্জেল বলেন, ভারতের ভেতরে একীভূতকরণের ধারণা এবং সে অনুযায়ী কাজ করার বিষয়টির সঙ্গে মিজোরামে প্রচলিত দাবিদাওয়ার মূল পার্থক্য হতে পারে।

“আগের মুখ্যমন্ত্রীও পুনর্মিলনের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা একই রক্তের মানুষৃ’। আগের যারা যা বলেছেন, আর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ভারতের ভেতরে পুনর্গঠিত হওয়ার কথা বলেছেন।”

ডুঞ্জেল বলেন, “এমনকি আগের মুখ্যমন্ত্রী এমনকি জোরো ও মিজো জিরলাইয়ের মত সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো মনস্তাত্ত্বিক পুনর্মিলনের কথা বলেছেন। যেখানে একই রক্তজাত এবং আলাদা সীমানায় বিভাজন সত্ত্বেও আমাদের একে অপরকে ভালোবাসতে হবে।
“লালদুহোমা নিজেদের পুনর্মিলনের কথা বললেও তিনি সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াইয়ের কথা বলেননি।”

জনগণ সমর্থন দিচ্ছে?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, চিন-কুকি-জো পুনর্মিলনের ধারণাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় এলেও এই ইস্যুটি তেমন গণআবেদন বা জনসমর্থন পায়নি।
চিন-কুকি-জো পুনর্মিলনের ধারণায় মিয়ানমার ও মণিপুরে অস্থিরতা হয়েছে। উভয় জায়গা থেকে আসা ১০ হাজারের বেশি কুকি-চিনকে আশ্রয় দিয়েছে মিজোরাম। শরণার্থীদের ব্যাপারে কেন্দ্রের নির্দেশনাও মিজোরাম অস্বীকার করেছে।

জোরো সভাপতি সাংকাওইয়া বলেন, চলতি বছরের শুরুতে মিয়ানমারের সঙ্গে ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ (এফএমআর) বাতিল করেছে ভারত। ওই চুক্তির আওতায় জাতিগোষ্ঠীগুলো সীমান্তের উভয়পাশে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে আসা-যাওয়া করতে পারতেন ভিসা ছাড়াই। দুই সপ্তাহ পর্যন্ত অবস্থানও করতে পারতেন।

“মণিপুরে যা ঘটছে তা দেখছে তরুণ প্রজন্ম। আমাদের অনেক ভাই এখানে উদ্বাস্তু হিসেবে এসেছেন। বার্মায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে…। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই আমরা এফএমআর উপভোগ করে আসছি; যদি বেড়া দেওয়া হয়, তাহলে সীমান্তের ওপারে আমাদের নিজস্ব লোকেদের কাছে আমাদের প্রবেশাধিকার থাকবে না। আমরা চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।”

পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপট প্রভাব ফেলছে?
গত বছর মিজোরামের ক্ষমতায় নিতে জেডপিএমের নেতৃত্ব দেন লালদুহোমা। এমএনএফ ও কংগ্রেসের বাইরে প্রথম দল হিসেবে তারা সরকার গঠন করেন।

বিজেপির নেতৃত্বাধীন উত্তর পূর্ব গণতান্ত্রিক জোটের সদস্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমএনএফ মিজোরামের ক্ষমতা হারায়। ফলে ওই অঞ্চলের একমাত্র রাজ্য মিজোরাম, যেখানে বিজেপি ও তার মিত্ররা ক্ষমতায় নেই।

লালদুহোমা নির্বাচনের দৌড়ে যে জায়গায় জোর দিয়েছিলেন সেটি হল, কেন্দ্রের কারও সঙ্গে হাত না মিলিয়ে জেপিএম ‘আঞ্চলিক চরিত্র’ রক্ষা করবে।
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ