বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ ফাল্গুন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
৩ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধু শেথ মুজিব ঘোষিত পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী সারা পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। খুলনা, রংপুর, সিলেট থেকে সান্ধ্য আইন জারির খবর পাওয়া যায়।
প্রকৃতপক্ষে পূর্ববাংলার বেসামরিক প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর আদেশ- নির্দেশে চলতে থাকলো। পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহ ইয়াহিয়া খানকে সচকিত করে তুললো। বাঙালিদের ক্ষোভের প্রচণ্ডতা তার ধারণার বাইরে ছিল।
পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের শান্ত করার লক্ষে ১০ মার্চ ঢাকায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক বৈঠক আহবান করেন। প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য ছিল কালক্ষেপণ। কারণ পূর্ব বাংলার সমর শক্তি বৃদ্ধি করতে সময়ের বেশ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার এই চালাকি ব্যর্থ হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি জনগণের প্রতি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। আজকের আহুত ধর্মঘটে রেল চললো না, গাড়ি রাস্তায় বেরুলো না, বিমান আকাশে উড়লো না। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোটাই ভেঙ্গে পড়লো। মানুষের কণ্ঠ থেকে রোষের আগুন ঝরে পড়তে লাগলো।
বঙ্গবন্ধু মুজিব সরকারের প্রতি দাবি জানালেন, ‘ সেনাবাহিনীকে অবশ্যই ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে এবং ৭ মার্চের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এদিন জনসভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী।
বিশাল ওই জনসভার গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী শক্তির লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে নিহত বাঙালিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী শক্তির এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে।’
অপর এক প্রস্তাবে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদীদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ও শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। একই দিন স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি ঘটনা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি এবং বাঙালির ভাষা- সাহিত্য- কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করা হবে, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
ঘোষণায় আরো বলা হয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।
এদিন হরতাল চলাকালে চট্টগ্রামে বাঙালিদের উপর বিহারিদের লেলিয়ে দেয়া হয়। ফলে হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিকাণ্ড ও গোলাগুলিতে চট্টগ্রামে ৪০০ জন হতাহত হয়। সারা দিন ফিরোজ শাহ কলোনি, আমবাগান, পাহাড়তলি, রেল কলোনি এবং এবং বিভিন্ন এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে। যশোরে এদিন সেনাবাহিনী জনতার মিছিলে গুলি চালালে অনেক হতাহত হয়।
এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে চিন, নেপাল ও পোল্যান্ডের কূটনীতিকরা পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন।