শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের নতুন আইনে ইটভাটায় জ্বালানি ব্যবহার, চুল্লি ও অবস্থানের বিষয়ে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, প্রায় ৯০ শতাংশ ভাটা ছয় মাসেও তা বাস্তবায়ন করেনি বলে উঠে এসেছে এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে সনাতন ও আধুনিক পদ্ধতির মোট ছয় হাজার ৬৩৭টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে মাত্র ৭৫৩টি নতুন আইনে বৈধভাবে ইট উৎপাদন করছে বলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। অবশ্য পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ৬৩ শতাংশ কারখানা আধুনিক চুলার শর্ত ইতোমধ্যে পূরণ করেছে। যেগুলো বাকি আছে, সেগুলোও ধীরে ধীরে চলে আসবে বলে ব্যবসায়ীদের ভাষ্য।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অনেকে নতুন আইনের শর্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, পুরনো চিমনির বদলে আধুনিক চুলা চালু করা হলেও বাকি শর্ত পূরণ না হওয়ায় তাদের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। এতে করে ১০ লাখ শ্রমিকের ইট উৎপাদন খাতে ‘অচলাবস্থা’ সৃষ্টি হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করেছেন তারা।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক এ আতিক রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন আইনে চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে সনাতন পদ্ধতি বদলে আধুনিক চুলা ব্যবহারের নির্দেশনা ছিল। “কিন্তু ৮৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ ইটভাটা সেই নির্দেশ মানেনি বলে আমরা গবেষণায় দেখেছি।”
যেসব ভাটা আইন বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলোর মধ্েয ৬৩৭টি জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে, ৭৩টি হাইব্রিড হফম্যান পদ্ধতিতে এবং অন্যগুলো টানেল বা অন্যান্য আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ইট পোড়াচ্ছে বলে তথ্য দেন তিনি।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ বলছে, দেশে চালু সাড়ে ছয় হাজার ভাটার মধ্যে এক হাজার ৭৪৫টিই আগে লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। সরকার দূষণ কমাতে ইটভাটায় আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহ যোগালেও মালিকরা মূলত মুনাফার কারণে সনাতনী পদ্ধতিতে ইট বানানো ছাড়তে চাইছেন না।
এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ১৭ দশমিক ২৪ বিলিয়ন পিচ ইট উৎপাদন হয়, যার জন্য লাগে ৫৮ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন টন কাঁচামাটি।
সনাতন পদ্ধতির ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাঠ কিংবা কয়লা। ভাটার স্থায়ী চিমনির উচ্চতা হয় সর্বোচ্চ ১২০ ফুট। কাঁচামাটি ব্যবহার করে বছরে ছয় মাস (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) ইট উৎপাদন করা যায়। এসব স্থায়ী চিমনি দিয়ে বের হওয়া ধোঁয়া ওজন স্তরের ক্ষতি করে; আশপাশের এলাকার পরিবেশও দূষিত করে তোলে।
পরিবেশবাদীদের দাবির মুখে সরকার ২০১৩ সালে ইটপ্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করে, যেখানে স্থায়ী চিমনির ইটভাটা নিষিদ্ধ করা হয়।
নতুন আইন যা বলছে
>> যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোন ব্যক্তি ইট বানানোর জন্য মজা পুকুর, খাল, বিল, খাঁড়ি, দীঘি, নদ-নদী, হাওর-বাওর, চরাঞ্চল বা কোনো পতিত জায়গা থেকে মাটি কাটতে বা সংগ্রহ করিতে পারবে না।
>> ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা যাবে না।
>> ইট পোড়ানোর কাজে নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত সালফার, অ্যাশ, মারকারি বা অনুরূপ উপাদান সংবলিত কয়লা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না।
>> স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মিত উপজেলা বা ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করে ভারী যানবাহন দিয়ে ইট বা ইটের কাঁচামাল পরিবহন করা চলবে না।
>> স্থায়ী চিমনির বিকল্প হিসাবে টানেল চুলা, ইমপ্রুভড জিগজ্যাগ চুলা বা হাইব্রিড হফম্যান চুলাকে বিকল্প হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে ইটভাটা মালিকদের নিয়ে আয়োজিত ‘গ্রিন ব্রিক কনভেনশনে’ অংশ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে ইটভাটা মালিকদের সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক ইট উৎপাদন পদ্ধতিতে আসার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেবল চুলা বদলালেই হচ্ছে না। নতুন আইনে ইটভাটার অবস্থানের বিষয়ে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে তাতে সনাতন পদ্ধতির ভাটাগুলো আধুনিক পদ্ধতির চুলা নিলেও আইনি বৈধতা পাচ্ছে না। আবার কাঁচামাল সহজলভ্যতার কারণেও অনেক মালিক সনাতন পদ্ধতি ছাড়ছেন না।
মেসার্স আতিক ব্রিকসের অংশীদার আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খুলনা, নোয়াখালী, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর ও তুলনামূলকভাবে প্রত্যন্ত এলাকার ইটভাটাগুলো সনাতন পদ্ধতিতেই থেকে গেছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় সহজে কাঠ মিলছে, তারা আগের স্থায়ী চিমনি পদ্ধতিতে ইট পোড়াচ্ছে।
তবে নিয়ম ভঙ্গকারী ভাটার যে পরিসংখ্যান সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ দিয়েছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক আজাদ।
“যেসব উৎস থেকে তথ্য নিয়ে ৮৮ শতাংশ ইটভাটা পুরনো পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন করছে বলা হচ্ছে- তা সঠিক নয়। কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের অধিকাংশ ইটভাটা জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে চলে এসেছে।”
অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আসাদুর রহমান খান ক্ষোভ প্রকাশ করলেন নতুন আইনের শর্ত নিয়ে।
তিনি বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্রিক ফিল্ড করা যাবে না, মহাসড়ক ও সওজের রাস্তা ব্যবহার করা যাবে না, লোকালয় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে থাকতে হবে- এমন সব শর্ত পূরণ করতে গেলে ইটভাটা চালানো সম্ভব না। “কড়াকড়ির কারণে ৮৮ শতাংশ কেন, মনে হচ্ছে যেন ৯৯ শতাংশ ব্রিকফিল্ডই অবৈধ হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
ইটভাটা কোথায় হবে
>> শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যেক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষি জমি, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, ডিগ্রেডেড এয়ার শেড এর মধ্যে ইটভাটা থাকতে পারবে না।
>> এসব এলাকার দুই কিলোমিটার বাইরে ইটভাটা নির্মাণ করতে হবে।
>> পরিবেশ অধিদপ্তর বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোন আইনের অধীনেই নিষেধাজ্ঞার এলাকায় ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি, ছাড়পত্র বা লাইসেন্স দিতে পারবে না।
ধামরাইয়ের ইটভাটা এআরবি এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর আসাদুর রহমান জানান, চিমনির বদলে আধুনিক চুলা ব্যবহার করেও ‘আইনি কড়াকড়ি’র কারণে ছাড়পত্র পাননি তিনি।
“আমরা দীর্ঘ ছয় বছর ধরে জিগজ্যাগ পদ্ধতি অনুসরণ করছি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর নতুন ছাড়পত্র দেয়নি। এখন এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।” আধুনিক ইটভাটা গড়তে সরকার যে বিশেষ ঋণ দিচ্ছে, তা কতটা সুফল দেবে- সে বিষয়েও সংশয় প্রকাশ করেন আসাদ।
“নতুন করে ৫৫ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া রংপুরের নাজ অটো ব্রিকসকে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ২০ হাজার ইট উৎপাদন করতে হবে। রংপুরের মতো অঞ্চলে প্রতিদিন এক লাখের বেশি ইট কীভাবে বিক্রি হবে?”
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্মাণকাজের জন্য দেশে ইটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভাটায় উৎপাদিত ইটের বাইরেও বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকার ইট আমদানি করতে হচ্ছে। ‘কড়াকড়ি’ কমলে সেই চাহিদা দেশ থেকেই মেটানো সম্ভব।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহা পরিচালক মো. রইছউল আলম ম-ল বলেন, বাস্তবতার কারণেই অনেক আধুনিক চুলার ইটভাটাকেও পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া যাচ্ছে না।
তবে ৯০ শতাংশ ইটভাটা আইন মানছে না- এমন তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মহা পরিচালকও।
“পরিবেশবাদিরা যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। তারা কোন উৎস থেকে এমন তথ্য পেয়েছেন আমি জানি না। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে ৬৩ শতাংশ কারখানা ইতোমধ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে চলে গেছে।”
আর যারা এখনও আইন বাস্তবায়ন করেনি, তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।
“সম্প্রতি খুলনা অঞ্চলে সাতটি ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বরিশাল, পটুয়াখালীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মোবাইল কোর্ট চলছে।” এর বাইরে সাড়ে সাতশ ইটভাটা আদালতে রিট করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে ‘আপাতত কিছু করার নেই’ পরিবেশ অধিদপ্তরের।- বিডিনিউজ