শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
বিচার বহির্ভুত হত্যার বৈধতা ও সাংবিধানিক ভিত্তি আছে কি না- বিষয়টি আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের একটি আলোচনা- সমালোচনার বিষয়। একেক সময় সরকার তাদের সুবিধেমত বাহিনি সৃষ্টি করে কিংবা অভিযানের নামকরণ করে অনেক সময় বিচার বহির্ভুত হত্যা সংঘটিত হয়। এর যৌক্তিকতার বিষয়টি সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তদুপরি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। যে দল সরকারে থাকে তাদের কাছে এর একরকম মানে, বিরোধীদের কাছে অন্যরকম। বিরোধিরাই যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন তারা তাদের পূর্বজদের অনুসরণ করে। এইভাবেই চলে আসছে। কিন্তু এই খেলাটি যদি সত্যিই অবৈধ অযৌক্তিক হয় তা হলে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্য হওয়া সমীচিন ছিল নয় কি? রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর এই স্ববিরোধিটা থেকেই গেছে। এ থেকে জাতীয় রাজনীতির নৈতিক অবস্থানটাও অনুমান করা যায়।
তবে এটাও ঠিক যে, সব হত্যাকা-কে ঢালাওভাবে বিচারবহির্ভুত বলতে হবে- তা নয়। মানবাধিকার বিষয়টি তো আর একপেশে কিছু নয়- তাকে সমান্তরাল চলতে হয়। প্রতিটি মানুষের জীবন রক্ষার অধিকার আছে। বাঁচার জন্য অন্যকে হত্যার প্রয়োজন হলে সেটিও তার অধিকারেরই অংশ। আসলে ঘটনাটি ঘটার পরিবেশ ও পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য।
বাংলাদেশে জঙ্গি নির্মূল অভিযানে জঙ্গিরা মারা পড়ছে এ নিয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও কথিত মানবাধিকার কর্মীরা জঙ্গির মানবাধিকার নিয়ে এখন বেশ উচ্চকণ্ঠ। এ নিয়ে নানা পরামর্শ, এনিয়ে বিনিয়ে কথার বলার মধ্যে জঙ্গিদের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন ভালবাসাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা একই সুরে একই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কথা বলছে। এসব কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপি জঙ্গি নামের যে আপদ মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে- সেই জঙ্গি-সন্ত্রাসীর মানবাধিকারকে কি মানবাধিকার বলা যায়? মানবাধিকার তো তারই থাকা চায়- যার কিনা নিজের জীবন ও অন্যের জীবনের প্রতি নূন্যতম ভালবাসা আছে। কোনো আত্মঘাতি জঙ্গির মানবাধিকারের কথা মাথায় নিয়ে যদি তাকে জীবিত ধরতে চায় তা হলে এ মানবসভ্যতা সুরক্ষা দেয়াটা পাগলামিই হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে জঙ্গি প্রতিরোধের অভিযানের নিকট দৃষ্টান্ত জাতির স্মৃতিতে জাজ্জ্বল্যমান। ফ্রান্সের ঘটনাতেও আমরা দেখেছি সে দেশের পুলিশ দুই জঙ্গিকে তেড়ে ধরে গুলি করে হত্যা করেছে, আমেরিকায় জঙ্গি না হওয়া সত্তেও কৃষ্ণাঙ্গদের পুলিশ সামান্য কারণে কীভাবে গুলি করে হত্যা করছে- সে বিষয়গুলো নিয়ে কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তেমনভাবে করছে না। গুলশানের আর্টিজানের ঘটনা জাতির সামনে অনেক শিক্ষাই দিয়ে গেছে। যারা নিহত হওয়ার জন্যই মানুষকে জবাই করে ( এমনকি গর্ভবতী নারীকে) তাদেরকে জীবিত ধরার মত যারা পরামর্শ দেয় তাদের অন্য কোনো মতলব থাকতে পারে।
২০০২ সালে সেনাবাহিনিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বা অস্ত্র উদ্ধারের নামে মাঠে নামানো হয়। এই অপরাশেনকে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নাম দেয়া হয়েছি। ওই সময় অপারেশন ক্লিনহার্টের অপারেশনে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়ে কম হইচই হয়নি। ওই সময়ের বিচারবহির্ভুত হত্যাকা-ের ব্যাপারে কমন ভাষা ছিল ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যু। ক্লিনহার্ট অপরেশনে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের কেহই কিন্তু জঙ্গি ছিল না। তাদের কেউ কেউ সন্ত্রাসী হলেও তাদের জীবনের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ-ভালবাসা ছিল। জঙ্গি এবং সমাজের প্রচলিত ধারণার অপরাধী এক বিষয় নয়। আত্মঘাতী জঙ্গি সামান্য সুযোগ করে দিলেই সে নিজে মরে, অনেক মানুষের জীবন নাশ করে দেয়। তাকে সে ভাবেই ট্রিট করতে হবে। বর্তমানের সমস্যাটা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও জঙ্গি নির্মূল এক সাথে হয় না- তা করতে গেলে সমাজে জঙ্গিবাদই কায়েম হবে। এমন উদাহরণ কম নয়- পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকে আমরা দেখছি। যারা জঙ্গি ও মানবাধিকারের ব্যাপারটিকে এক পাল্লায় মাপতে চাচ্ছেন তারা কী ওইসব দেশের পরিণতি বাংলাদেশে ডেকে আনতে চান?