জঙ্গি আমিজুল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত মরদেহ গ্রহণে পিতার অস্বীকৃতি

আপডেট: মার্চ ৩, ২০১৭, ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গোদাগাড়ী প্রতিনিধি



বগুড়ার শেরপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন নিষিদ্ধ সংগঠন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা আমিজুল ইসলাম ওরফে আলামিন ওরফে রনি (২৬)। পুলিশ বলছে, গোয়েন্দা পুলিশের দুই সদস্যের ওপর হামলাকারী নিহত আমিজুল উত্তরবঙ্গের সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার ছিলেন। আমিজুল শেরপুরের জোয়ানপুরে বোমা বিস্ফোরণের মামলার সন্দিগ্ধ আসামি। তার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার বুজরুক রাজারামপুর মহল্লায়।
এদিকে নিহত জঙ্গি নেতা আমিজুলের পিতা দুরুল হোসেন তার সন্তানের মরদেহ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার মরদেহ বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত জঙ্গি নেতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে এখনো রেসপন্স করেন নি। পরিবারের সদস্যরা আসলে তাদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। অপরদিকে আমিজুলের মৃত্যুর খবরে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভুইয়া গতকাল বৃহস্পতিবার গোদাগাড়ী মডেল থানায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এছাড়া নিহত আমিজুলের ব্যাপারে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। আচার-আচরণে শান্ত দুর্ধর্ষ প্রকৃতির শীর্ষ জঙ্গি নেতা আমিজুল সর্বশেষ নব্য জেএমবির উত্তরবঙ্গের সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার হিসেবে কাজ করছিলেন। সাবেক ছাত্রশিবির নেতা আমিজুল মঙ্গলবার রাতে দুই পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার আগে নব্য জেএমবির সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণী ফোরাম ‘মজলিসে শুরা’র এক সদস্যের সঙ্গে রাজশাহী নগরীতে বৈঠক করেন। এছাড়া তার বাড়িতে নব্য জেএমবি’র নিয়মিত বৈঠক হত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
অপরদিকে গতকাল বুধবার দিবাগত রাত তিনটায় শেরপুরের সীমাবাড়ী-রানীরহাট আঞ্চলিক সড়কের উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের জামনগর কালভার্টের পাশে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ এই ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, তিনটি গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে।
শেরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খান মো. এরফান বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত নয়টায় শেরপুর থানার পুলিশ ও বগুড়ার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আমিজুলকে তার নিজ মহল্লা থেকে আটক করে। এ সময় আমিজুলের ছুরিকাঘাতে গুরতর জখম হন বগুড়ার গোয়েন্দা পুলিশের কনস্টেবল আবদুস সালাম পিপিএম ও ইসমাইল হোসেন। এরপর আহত দুই কনস্টেবলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওসি আরও বলেন, আটকের পর আমিজুলকে নিয়ে শেরপুর থানার পুলিশ ও বগুড়ার গোয়েন্দা পুলিশ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্থানে নব্য জেএমবির অন্য সদস্যদের আটকে অভিযান চালায়। মঙ্গলবার রাতে আমিজুল পুলিশকে কার গ্রামের বাড়িতে অস্ত্রের কারখানা রয়েছে বলে সন্ধান দেন। এই খবরে ওই সড়ক দিয়ে গাড়িযোগে যাওয়ার সময় উপজেলার জামনগর কালভার্টের কাছে পৌঁছালে নব্য জেএমবির আমিজুলের সহযোগীরা ডিবি পুলিশের গাড়িতে আক্রমণ করে আমিজুলকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। তখন আমিজুল পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শেরপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) বুলবুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়া অস্ত্র ছিল নব্য জেএমবি ক্যাডারদের। কয়েকজন জেএমবির সদস্য পুলিশের গাড়িতে আক্রমণ করেছিল। পুলিশ ও জেএমবির মধ্যে গোলাগুলির সময় আক্রমণকারী অন্য জেএমবির সদস্যরা পালিয়ে যায়।
অপরদিকে গোদাগাড়ী প্রতিনিধি জানান, আমিজুলের মৃত্যুর খবরে গোদাগাড়ী পৌর এলাকার বুজরুক রাজারামপুর মহল্লা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এলতাস হোসেন বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে এ এলাকায় মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। এই দুর্ধর্ষ জঙ্গি নিহতের খবরে কিছুটা হলেও মানুষের মাঝ থেকে আতঙ্ক দূর হয়েছে। তবে এই দুর্ধর্ষ জঙ্গির সাথে এলাকার আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা খুঁজে বের করার দাবি জানান এই মুক্তিযোদ্ধা।
এ প্রসঙ্গে গোদাগাড়ী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিপজুর আলম মুন্সি বলেন, ডিবি পুলিশের উপর হামলার পর থেকে পুলিশ এলাকায় নিয়মিত টহল দিচ্ছে এবং পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।
এলাকাবাসি জানান, গোদাগাড়ী উপজেলার সারাংপুর গ্রামের দুরুলের ছেলে আমিজুল আট বছর থেকে বুজরুক রাজারামপুরে তার সৎ বাবা আতাউর রহমানের বাড়িতে অবস্থান করছিল। তিনি বাবার কাছে আসতেন না। সৎ পিতার কাছেই থাকতেন। নির্মাণ শ্রমিক আমিজুল একবছর থেকে নিজকে বদলে দিয়ে জুব্বা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরা শুরু করে। গতকালও আমিজুলের সৎ বাবা আতাউর রহমানের বাড়িতে তালা ঝুলছিল। মঙ্গলবার ঘটনার পর থেকে আমিজুলের মা, সৎ বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
আমিজুলের পিতা দুরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার সাবেক স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর থেকেই আমিজুল আমার সঙ্গে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখত না। সে দেশদ্রোহী। দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত সন্তানের লাশ আমার পক্ষে গ্রহণের প্রশ্নই উঠে না।
অপরদিকে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশকে ছুরিকাঘাতকারী আমিজুল ইসলাম জেএমবির দুর্ধর্ষ জঙ্গি। আমিজুল বর্তমানে নব্য জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। গোদাগাড়ীর বুজরুক রাজরামপুর মহল্লায় সৎ বাবা আতাউর রহমানের যে বাড়িতে আমিজুল মাঝে মধ্যে গিয়ে থাকত সেখানেই জেএমবির গোপন বৈঠক ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত। শিবির ছেড়ে বছরখানেক আগে সে জেএমবিতে সক্রিয় হয়। বিভিন্ন অ্যাপ কোডের মাধ্যমে জেএমবির শূরা ‘যাযাবর’র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত আমিজুল। গত এক মাস ধরে তাকে আটকের চেষ্টা করছিল গোয়েন্দা পুলিশ।
এছাড়া মঙ্গলবার রাতে দুই পুলিশকে ছুরিকাঘাতের আগে সে জেএমবির এক শূরা সদস্যের সঙ্গে রাজশাহী নগরীতে গোপনে এক ঘণ্টার একটি বৈঠকও করে এবং সন্ধ্যার পর গোদাগাড়ীতে পৌঁছায়। আইনশৃংখলা বাহিনীর একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভুইয়া বলেন, খোঁজ-খবর নেবার জন্য আমি গোদাগাড়ীতে আজ ( বৃহস্পতিবার) গিয়েছিলাম। এছাড়া দুই পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার পরেই ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমরা সার্বক্ষণিক ঘটনাটির আপডেট তথ্য সংগ্রহ করছি। এছাড়া পুরো জেলায় জঙ্গি নেটওয়ার্কের বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্তদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ