জঙ্গি মতাদর্শ ঠেকাতে বাংলাদেশ কতটুকু চেষ্টা করছে?

আপডেট: জানুয়ারি ২১, ২০১৭, ১২:১৬ পূর্বাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক


গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরায় দেশের সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করছে।
এসব অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা মারা পড়ছে, আবার জীবিতও আটক হচ্ছে। গুলশান হামলা পরবর্তী পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা জোরদারের সঙ্গে গুরুত্ব পাচ্ছে জঙ্গিবাদী আদর্শ মোকাবেলার বিষয়টি।
গুলশান এবং বিভিন্ন হামলায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ কখনোই দেশের মধ্যে এই গোষ্ঠীাটর অস্তিত্ব মেনে নেয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষায় আইএস’র মতাদর্শে বাংলাদেশে ‘নব্য জেএমবি’র উত্থান হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত তরুণরা যুক্ত হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি পুলিশের এক অভিযানের সময় একজন নারীকেও আত্মঘাতি হতে দেখা গেছে।
সুইডেনে অবস্থানকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক তাসনিম খলিল জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করছেন। জঙ্গিদের মূল বার্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, “ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও শরীয়া আইন কায়েম হলো জিহাদীদের মূল লক্ষ্য। তারা বলেন এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আধুনিক রাষ্ট্রের (জিহাদীদের ভাষায় তাগুতী শাসনব্যবস্থা) বিরুদ্ধে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ করতে হবে।”
তিনি আরও বলছেন, “এই তরুণরা মনে করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের উপর অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং ভিন্নধর্মীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ধর্মযুদ্ধ করাটা হলো বীরত্ব প্রদর্শনের সুযোগ।”
মি. খলিল মনে করেন ইসলামের নামে এই বার্তা নিয়ে জিহাদীদের রিক্রুটমেন্ট হয় সরাসরি  স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মসজিদ, মাদ্রাসা থেকে। আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে মূলত হয় প্রচার-প্রোপাগান্ডার কাজটি (জিহাদিদের ভাষায় দাওয়াতি মিডিয়ার কাজ) – জিহাদি বার্তা, অডিও, ভিডিও, লেকচার প্রচার করা হয়।
“আত্মঘাতী হামলার ক্ষেত্রে অবশ্য শহিদ হয়ে সহজেই বেহেশতে যাওয়ার তীব্র লোভ বা বাসনা কাজ করে।”
যেহেতু ধর্মের নামে জিহাদের ডাক এবং প্রলোভন দিয়ে জঙ্গিবাদ ছড়ানো হচ্ছে, তাই এর প্রতিরোধে আদর্শিক লড়াই দরকার বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশে গুলশান হামলার পর দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তৎপর হতে বলা হয়। ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান তারা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত মনিটর করেন এবং অভিভাবকদেরকেও অবহিত করেন ও পরামর্শ দেন।
কিন্তু একটি বিষয় দেখা গেল ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যাসহ ইসলাম শিক্ষার মতো পাঠ্যবই ইংরেজি মাধ্যমে বাধ্যতামুলকভাবে নেই।
মি. আক্তারুজ্জামান বলেন, “আমাদের স্কুল এবং আরো যে স্কুলগুলো আছে, সেগুলো কেমব্রিজ কারিকুলাম ফলো করছে বা এডিকসেল কারিকুলাম ফলো করছে। তারা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল কারিকুলামকে ফোকাস দেয়। আমরা অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ পড়াচ্ছি কিন্তু রিলিজিয়ন পড়াচ্ছি না”। ইতিবাচক তবে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো তৎপরতা দরকার।
মি. আক্তারুজ্জামান মনে করেন ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে সরকারিভাবে সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের জন্য একটি পাঠ্যবই নির্ধারণ করে দিলে তা ভাল হয়।
ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক সিরাজ উদ্দীন আহমাদ বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে ক্লাসে ধর্মীয় বিষয়ে সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া মাদ্রাসা বোর্ড পাঠ্যবই সংশোধনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
“মাদ্রাসা বোর্ড এটার জন্য আট জনের একটা কমিটি করে দিয়েছে, সেই কমিটিতে আমিও ছিলাম। সেই কমিটির আওতায় ৩২টি বই সংশোধনের জন্য আমরা বৈঠক করে কমিটির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দিয়েছি।”
মি. আহমাদ অবশ্য জানান যে এবছরও সে সংশোধন কার্যকর হয়নি।
গত বছর জুলাই মাসে গুলশান হামলার পর জঙ্গি দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান চলছে। বড় দশটি অভিযানে অন্তত ৩৫ জন জঙ্গি সন্দেহে নিহত হয়েছেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বা আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ইসলামের খ-িত ব্যাখ্যা দিয়ে যেহেতু ইসলামী চিন্তাভাবনা নিয়ে জঙ্গি সৃষ্টি হয়, সে কারণে ধর্মীয় নেতা বিশেষ করে আলেম-ওলামা-মসজিদের ইমামদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি এবং তাদের মাধ্যমে আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়াও দিয়েছি।
তিনি বলেন, “পরিবার-প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় – সকল সেক্টরে এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি”।
গবেষক শাফকাত মুনীর বলেন, উগ্রবাদ ঠেকাতে সরকারের নেয়া কিছু উদ্যোগ ইতিবাচক, তবে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো তৎপরতা দরকার।
তিনি বলেন, “ধর্মযাজক ও আলেম-ওলামা যারা আছেন তাদেরকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে সবাই মিলে একটা কাউন্টার ন্যারেটিভের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে আরো পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে জঙ্গি বা উগ্রবাদ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের মডেল থেকে শিক্ষা নিতে পারি অথবা আমাদের মতো কাস্টমাইজ করে নিতে পারি। শুধু আভিযানিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দমন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এটি মূলত একটা আদর্শগত লড়াই।”- বিবিসি বাংলা