জননেতা মাদার বখশ্ : জীবন ও সংগ্রাম

আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২৩, ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ

তসিকুল ইসলাম রাজা:


মাদার বখশ্ একটি নাম। একটি ইতিহাস। তাঁর বিস্ময়কর সংগ্রামী ও আপসহীন জীবন আমাদের সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর আসাধারণ নেতৃত্ব শক্তি দুর্জয় সাহস, অনমনীয় প্রতিজ্ঞা এবং কঠোর ও কঠিন আত্মত্যাগ জাতীয় জীবনে স্মরণীয় সঞ্চয় হয়ে রয়েছে। তাঁর জীবন দর্শনের মূলমন্ত্র হলো সর্বদাই মানব কল্যাণে ও জনহিতকর মহৎ কর্মে নিজেকে উৎসর্গিত করা। সেই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই তিনি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর জন্ম না হলে হয়তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতো না। ১৯৫৩ সালে রাজশাহীতে এই প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। এই প্রতিষ্ঠার ফলে সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং সমগ্র বিশ্বে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ জন্য আমরা তাঁর কাছে অশেষ ঋণে আবদ্ধ।
এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ১৯০৭ সালে তৎকালীন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সিংড়া থানাধীন স্থাপনদিঘি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এক অতি সাধারণ গৃহস্থ পরিবারে তাঁর জন্ম হলেও স্বীয় মেধা, মনন ও যোগ্যতা বলে তিনি নিজেকে সুযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি একেবারে অজপাড়া গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে সুদৃঢ় সংকল্পকে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে জনগণের নন্দিত নেতা হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।
তাঁর পিতা বলিউদ্দিন মন্ডলের কয়েকটি সন্তান ভূমিষ্ট হবার পরপরই মারা যায়। এর ফলে তাঁর পিতা-মাতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য বা রেহাই পাবার জন্য তাঁরা চলনবিল এলাকায় অবস্থিত মাদারপিরের দরজায় মানত সাধন করেন। বিধাতার ইচ্ছায় আবার তাঁদের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁরা সেই বিখ্যাত মাদার পির বাবার নামানুসারে পুত্রের নাম রাখেন মাদার বখশ্।
এই সেই অনেক সাধনার ঋণ মাদার বখশ্ সিংড়া থানার চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১৯২২ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আই-এ এবং ১৯২৬ সালে বি.এ পাস করেন। তাঁরপর আর্থিক সংকট তাকে অক্টোপাশের মতো ঘিরে ফেলেছিল। কিন্তু তিনি কোন বাধাকেই বাধা মনে না করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি কলকাতায় গমন করেন। সেখানে প্রাইভেট পড়িয়ে এবং অবসর সময়ে পত্রিকা অফিসে কাজ করে তিনি অশেষ কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে ইতিহাস বিষয়ে এম.এ পাস করেন। সে সঙ্গে তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্র অবস্থায় যখন তিনি কলকাতার কারমাইকেল ছাত্রাবাসে অবস্থান করছিলেন তখন তাঁর এককক্ষী বন্ধু ছিলেন প্রখ্যাত পন্ডিত, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক ও মুহম্মদ এনামুল হক। তিনি মাদার বখশ্ সাহেবের সংগ্রামী জীবন ও প্রতিভা সম্পর্কে একটি বাণীতে উচ্চারণ করেন
“মাদার বখশ্ ছিলেন আমার কলিকাতার কারমাইকেল ছাত্রাবাসের এককক্ষী বন্ধু (Chum)। তিনি পড়তেন ইতিহাস ও আইন আর আমি পড়তাম বাংলা সাহিত্য। বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়। আমি হব শিক্ষক আর তিনি হবেন উকিল- তা কখনও ভাবিনি। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাপ্নিক ও স্রষ্টা, চলনবিল আবাদের অক্লান্ত কমী, উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠনের ভাবুক, মিউনিসিপ্যালিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ জনসেবক মাদার বখশ্ পশ্চাতে মহিমার রথ রেখে সম্মুখেপানে চলে গেছেন। তাঁর উপরে আল্লার করুণা বর্ষিত হউক।”
এই একটি ছোট্ট বাণীতে জননেতা মাদার বখশের জীবন ও সাধনা সম্পর্কে যথার্থই মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর এই অসাধারণ মূল্যায়ন রাজশাহীবাসীর জীবনে স্মরণীয় সঞ্চয় হিসেবে গণ্য হবে।
বৃটিশ রাজ তাঁকে ভালভাল চাকরির জন্য প্রস্তাবসহ সুযোগ সুবিধা দানের প্রস্তাব করে। কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১৯৩৪ সালে তিনি রাজশাহী জজকোর্টে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। সে সময় রাজশাহী জজকোর্টে এবং রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন খান বাহাদুর এমাদ উদ্দীন (১৮৭৫-১৯৩৬)। তাঁর জীবন দর্শন ও আদর্শকে নিজ জীবনে ধারণ করে তিনি জীবন চলার পথের শুরুতেই নিজেকে সেভাবে তিলেতিলে বিনির্মাণ করেন। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ নেতা ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র নামে খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) সাহেব রাজশাহীতে আসেন এবং হযরত শাহ মখদুম বাবার মাজারের সামনের বিশাল মাঠে এক জনসভায় জমিদার হাজি লাল মোহাম্মদ সরদার (১৮৪৮-১৯৩৬) এর জ্যেষ্ঠপুত্র এবং আমাদের জাতীয় নেতা শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান (১৯২৩-১৯৭৫) সাহেবের পিতা আব্দুল হামিদ মিয়া (১৮৮৬-১৯৭৬) কে সভাপতি এবং মাদার বখশ্ (১৯০৭-১৯৬৭) কে সাধারণ সম্পাদক করে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত করেন। তাঁদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বৃহত্তর রাজশাহীতে অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগের রাজনীতি রাজশাহী চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মূলত মাদার বখশ্ মুসলিম লীগের চড়ষরপু গধশবৎ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সমগ্র জেলায় তাঁর নেতৃত্বে ও প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সমগ্র জেলায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলস্বরূপ, আইন ব্যবসায় যেমন তিনি সফলতা অর্জন করেছিল, তেমনি রাজনীতির অঙ্গনেও তাঁর জনপ্রিয়তা এবং ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৬ সালে আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা থানার নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে তাঁর অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল ঈর্ষনীয়। তিনি প্রগতিশীল ও উদার মুক্তমনের মানুষ ছিলেন। এ সব কারণে রাজশাহীতে হিন্দু-মুসলিম-দাঙ্গা হয়নি। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য ছিলেন। আইন সভার সদস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৯৫০ সালে রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি রাজশাহীতে প্রথম রিকসা চালু করেন। গৌরহাঙ্গায় নিউমার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাজশাহীতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি মুসলিম লীগের নেতা সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তাঁর নিজের শক্ত অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। তিনি রাজশাহী ভাষা সংগ্রামীদের নেতৃত্বে আয়োজিত ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ভুবনপার্কে উপস্থিত হন এবং বজ্রকন্ঠে মুসলিম লীগ নেতা মুসলিম লীগের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ও সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করে বলেন, ‘যদি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া না হয়, তবে আমি আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করবো।’- এই বক্তৃতা দানের কারণে রাতেই তাঁকে পুলিশ জেলখানায় নিয়ে যায়। তারপরও তিনি কোন অন্যায়ের কাছে কখনোই মাথা নত করেন নি। তাঁর এই আপসহীন ও সংগ্রামী জীবন প্রশংসার দাবী রাখে। মহান জননেতা মাদার বখশ্ ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হন। তারপরও তিনি সমাজসেবার কাজে পিছুপা হননি। তাঁর জীবনের শেষ ফসল রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। তিনি যখন খুবই অসুস্থ ছিলেন সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) ছয় দফার আন্দোলনে রাজশাহীতে এসেছিলেন এবং মাদার বখশ্ সাহেবকে তাঁর বাসায় দেখতে এসেছিলেন। জননেতা মাদার বখশ সাহেবের জামাতা জননেতা এম আতাউর রহমান (১৯২৫-১৯৮০) সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আর সে জন্যই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাজশাহী জেলার গভর্নর নির্বাচিত করেন।
মাদার বখশ্ সাহেব সর্বপ্রথম রাজশাহীকে শিক্ষানগরীতে পরিণত করেন। রাজশাহী শহরের বিভিন্ন মহল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রধান কারিগর ঠিলেন জননেতা মাদার বখশ্। তিনি প্রথম পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নানামুখী গঠনমূলক কর্মপ্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ও অবদানে রাজশাহীর প্রতিটি পর্যায়ে প্রথম উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ রচিত হয়েছে। এ জন্যই তাঁর মতো মানুষকে আমাদের অবশ্যই প্রতিনিয়তই শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় মণীষীতুল্য ব্যক্তিত্ব জননেতা মাদার বখশ্ মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালের ২০শে জানুয়ারি (৬ মাঘ ১৩৭৩) শুক্রবার বিকেল ৩টায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর নামে মাদার বখশ্ হল আছে। এছাড়াও রাজশাহী জজকোর্ট হতে সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তাটি তাঁর নামে রয়েছে। কিন্তু কোথাও নেম প্লেট বা সাইনবোর্ড দেখা যায় না। এবিষয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন মেয়র মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ সঙ্গে মাদার বখশ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজটিকে সরকারিকরণ সহ বিশ^বিদ্যালয় ঘোষণার জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মহানুভব দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা আশা করি, সরকার প্রধান আমাদের প্রাণের দাবিটি মেনে নিবেন।
লেখক: কবি ও গবেষক