মাহাবুল ইসলাম:‘ইদ মানে আনন্দ, ইদ মানে উৎসব’- এ অপ্তবাক্যটি বাঙালির ইদ উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ইদের এ আনন্দ উদযাপনে সকল পরিবারই চাই অন্তত এ দিনটিতে পছন্দের খাবার আয়োজনের। পছন্দের খাবার তালিকায় অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মাংস। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্যে সবার তা জোটে না! আর মাংসের দামের ক্রমবর্ধমান বাজার মূল্যে অনেক পরিবারের ইদ আনন্দে ভালো খাবার আয়োজনে যখনই ভাটা পড়তে শুরু করেছে, তখনি বিকল্প হিসেবে রাজশাহীতে জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মাংস সমিতি’। ইদে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মাংস খেতে বছর ধরে এ মাংস সমিতিতে সঞ্চয় করছেন মানুষ।
রাজশাহীর পবা উপজেলার দামকুড়া থানাধীন মুরারীপুর নিচপাড়া এলাকা। এ এলাকায় অন্তত দুইশো পরিবারের বসবাস। এখানকার হাতে গোনা দু’একটি পরিবার ছাড়া সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত। যাদের সিংহভাগের পেশায় কৃষি। পরিবারের নানা অভাব-অনটনের মধ্যে ইদের দিনটিকে সুন্দর খাবার আয়োজনে অধিকাংশ পরিবারই এবার মাংস সমিতি করেছেন। মোট চার টি ‘মাংস সমিতি’ এবার সক্রিয় ছিলো। ২৬ ও ২৭ রজমানে এই চার সমিতির চারটি গরু জবাই করে মাংস ভাগ করে নিয়েছেন। যে গরুগুলোর ওজন ৬ থেকে ৮ মণ।
এ মাংস সমিতির একটি সমিতির সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন সজিব হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় অধিকাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। যারা ইদের সময় সন্তান, পরিবার-পরিজনের জন্য পোশাকসহ অন্যান্য বাজার করার পর এতো দামের মাংস পাতে জুটাতে পারেন না। অনেক পরিবার ব্রয়লার মাংস দিয়েই সাধ মেটানোর চেষ্টা করেন। আবার কেউ কেউ মাছ দিয়েও ইদের খাবার আয়োজন শেষ করেন। একারণেই মাংস সমিতি গল্পের ছলেই গত বছর তৈরি হয়। এখন তা খুব জনপ্রিয়।
সমিতির সদস্য মো. ইয়াসিন আলী বলেন, প্রতি সপ্তাহে ১০০ টাকা করে মাংস সমিতি দেয়। আসলে সমিতি না করলে গরু মাংসের যে দাম, তাতে মাংস খাওয়া আর হবে না। এবার প্রায় ৭ কেজি মাংস পেয়েছি। পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের আতিথেয়তায় মাংস নিয়ে তেমন ভাবতে হয় নি। বিগত বছরগুলোতে এসময় ধার করতে হয়েছে।
আরেক সদস্য মিনারুল ইসলাম বলেন, একজনের আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হয়। ইদের সময় পরিবারের জন্য পোশাক কিনতে গিয়েই হাত ফাঁকা হয়ে যায়। এরমধ্যে ইদের সময় আত্মীয় স্বজনরা আসে। সবমিলিয়ে ইদ উৎসবকালীন অনেক ধার হয়ে যায়। অনেক সময় ঋণ পর্যন্ত করতে হয়েছে। তবে এবার আর মাংস নিয়ে বাড়তি তেমন কোন চিন্তা নাই। কষ্ট করে প্রতি সপ্তাহে যা জমিয়েছি, তা দিয়েই এবারের ইদে তৃপ্তি সহকারে মাংস খেতে পারবো।
এ সমিতি শুধু রাজশাহীর একটি গ্রাম নয়; নগরসহ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে গত বছর থেকে এ মাংস সমিতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেটিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, কোন একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; দেশের বিশেষায়িত একটি উৎসব উদযাপন কেন্দ্রীক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গ্রামে গ্রামে এমন সমিতি প্রশংসনীয়। নিজেদের চাহিদা পূরণে কারও কাছে হাত না পেতে এক মুঠো এক মুঠো করে সবাই মিলে চাল জমিয়ে একটি উৎসব আয়োজনের এ সামাজিকতা বহু আগের। তেমনি গ্রামে গ্রামে এমন সমিতি প্রশংসার। তবে শুধু একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। কারণ আমাদের সমস্যা শুধু একটি পণ্যে নয়।
সামাজের আরও যত সমস্যা আছে তা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাধানে অগ্রসর হতে হবে। তবে একটি সুন্দর সমাজ বির্নিমান হবে। আর এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে ক্যাবের রাজশাহী শাখা সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, সামাজিক এ প্রথা অনেক আগের। তবে সাম্প্রতিকালে এটির প্রচলন তেমন ছিলো না। কিন্তু এখন বাজারে মাংস ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই এ সমিতি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে এটা কোন পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান না।