রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৯ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. আব্দুল আজিজ সৌখিন
মানুষ মানুষের জন্য। শধু তাই নয়, মানুষ হল সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। আবার চন্ডিদাস বলেছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহায় উপরে নাই।” এবং সোফিস্ট ধারার দার্শনিক প্রেটাগোরাস বলেছেন “মানষই সব কিছুর মাপকাঠি।” তাইতো মানুষে যখন কোন বিপদে পড়ে বা সমস্যাগ্রস্ত হয় তখন সে অন্য মানুষের শরণাপন্য হয়। বিশেষ করে তার প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় এ জাতীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ইত্যাদি। আদিমকাল থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে দলবদ্ধভাবে বসবাস করেছে। নিজের ও অন্যের প্রয়োজনে একজন পাশে দাঁড়িয়েছে অন্যজনের। বাড়িয়ে দিয়েছে দুর্বলের প্রতি সবলতার সহমর্মিতার হাত। মানুষ আদিম কালে যখন পশু শিকারে যেত তখনো যেত দলবদ্ধভাবে। যাতে যেকোনো বিপদের সম্মুখিন হলে একসাথে প্রতিরোধ করতে পারে। শুধু তাই নয়, এই দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়ে নিজেদের এ সমাজের প্রয়োজনে দলের মধ্য থেকে একজনকে নেতা নির্বাচন করা হতো। যেকোনো সমস্যার কথা মানুষ জানতে পারে এবং তিনি সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা করতেন। সাড়া দিতেন তাদের তাকে, পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন সবার।
প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ যখন বসবাস করতো তখন থেকে আজ পর্যন্ত এ ধারা চলে আসছে। আর তাইতো আদিম সমাজে যেভাবে গোত্রপতি/দলপতি/সমাজপতি/মোড়লরা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতো ঠিক সেভাবে আজ আধুনিক সমাজে আমরা পাশে পাই গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এবং আমরা এটা চাইও যে, তারা আমাদের পাশে থাকুক। আর তাইতো এই আধুনিক সমাজে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেদের মূল্যবান ভোট প্রদান করে আমরা নির্বাচিত করি জনপ্রতিনিধি। তাদের হাতে তুলে দেই আমাদের ভাগ্যের/পরিবেশের/সমাজের উন্নয়নের দায়িত্ব। কিন্তু এই জনপ্রতিনিধিরা যদি আমাদের সমাজের রক্ষক বা নেতা হয়ে আমাদের দায়িত্ব নিতে না পারেন তবে তাদের উক্ত পদে বহাল থাকা উচিত নয়। একজন জনপ্রতিনিধি যখন প্রকাশ্যে বলে আপনার ঘরে গিয়ে আমি মশারি টানাতে পারবো না, আপনার ছাদের উপরের চৌবাচ্চায় আমি ওষুধ লাগতে পারবো না। এ কথায় যা দাঁড়ায়- তিনি তাদের দায়িত্ব নিতে পারছেন না। তাহলে আমাদের প্রশ্ন হল আপনাদের জনপ্রতিনিধি হবার দরকার কী?
হযরত ওমর (রা.) যদি অর্ধবিশ্বের প্রতিনিধি হয়েও নিজে প্রজাদের দুঃখ দূর করার জন্য আটার বস্তা কাঁধে করতে পারেন তবে আপনি কেন একটি শহরের মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে পারবেন না? মাননীয় মেয়র সাহেব আপনার কথার সূত্র ধরেই বলি- আচ্ছা মনে করে নিলাম চিকুনগুনিয়া নিয়ে আগাম কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি। কিন্তু যখন শুরু হয়েছে তখন কেন এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করলেন? অথচ সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, গত বছরের ডিসেম্বরে আইইউডিসিআর ৩০ জন রোগী সনাক্ত করেছিল। আচ্ছা মানলাম আপনি নিজে যেতে পারবেন না, তাহলে আপনার প্রতিনিধি হিসেবে কাউন্সিলর, সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তা-কর্মচারী এদেরকে তো পাঠানো যায়। যদিও এদেরকেও না পাঠানো যায় তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে এদেরকে ছাঁটাই করে দিন। আমি মনে করি, আপনি মনে প্রাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিশ্বাস করেন এবং তার আদর্শ বুকে ধারণ করে রাজনীতি করছেন, আওয়ামী লীগের হয়ে। অথচ আপনি কি জানেন না যে, এই বঙ্গবন্ধুই আজীবন গরিব-দুঃখী, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন? যখন ১৯৭০ এর নির্বাচন হয় ঠিক তখনো নির্বাচন কাজ ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু ছুটে গিয়েছিলেন বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষের পাশে। এই বঙ্গবন্ধুই নিজের ব্যবহৃত জিনিস রাস্তার দরিদ্র মানুষগুলোকে দান করে বাড়িতে ফিরে আসতেন খালি হাতে। আসলে মাননীয় মেয়ব সাহেব আপনি যে কথাটি বলেছেন, একজন জনপ্রতিনিধির কাছে এরকম বক্তব্য আশা করে না জনগণ। জনগণ ্আপনাদের র্নিবাচিত করেছে হতাশ হবার জন্য নয়, বরং নিজের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার আশাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য। এই আপনারা জনপ্রতিনিধিরাইতো ভোট চাওয়ার সময় ঠিকই বাড়ি বাড়ি যেতে পারেন। হাজারো প্রতিশ্রুতি দেন জনগণকে। তাহলে নির্বাচিত হবার পর যেতে পারবেন না কেন?
দেশের অধিকাংশ জায়গায় যখন মানুষ বন্যায় পানিতে ভাসছে ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কাতরাচ্ছে তখন কেন আপনারা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারবেন না? এখন কেন আপনারা বাড়ি বাড়ি বা মহল্লায় মশা নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন না? কেন পারবেন না, বানভাসি মানুষের পাশে গিয়ে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়াতে?
বানভাসি মানুষের কথা যেহেতু আসলো তখন তাদের কথা একটু বলি। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম বন্যায় দুর্গত মানুষগুলো কত কষ্টেই না জীবন যাপন করছে। একটু ত্রাণের জন্য তারা চেয়ে আসছে আপনাদের দিকে, চেয়ে আছে সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দিকে। অথচ তারা পাচ্ছে না পর্যাপ্ত কোন ত্রাণ। প্রথম আলোর ১৪-০৭-১৭ তারিখের সংবাদে উঠে আসা একজন বানভাসি মানুষের বক্তব্য ছিল এরকম “ ১০ দিন পানিবন্দী। উঠানত এক বুক পানি। শোবার ঘরের চোকি ডুবে আছে। চুলায় আগুন ধরাবার জায়গা নাই। বিয়ানবেলা (সকালবেলা) কলার ভেলতি চুলা বসিয়ে ছলগুলোর (বাচ্চাগুলোর) জন্যি একটু খিচুড়ি রান্না করিছি। পানির কল সব ডুবে গেছে। ঘরত সামান্য চাল আছে। পানিবন্দী চরত কেউ খোঁজ খবর লিবার আসে না। ইলিফপও পৌছায় না! নিলুফা বেগম (৩৬)।” বন্যা দুর্গত এলাকায় চলছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম হতে জানা যাই ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ২ জন, গাইবান্ধায় ৪ জন মারা গেছে। চিলমারী উপজেলায় ১ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রামে ২০ হাজার, গাইবান্ধায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি এবং বন্যাকবলিত অন্যান্য এলাকার অবস্থা প্রায় একই।
এবার আসি আবার চিকুনগুনিয়ায়। চিকুনগুনিয়া নিয়েও চলছে বিতর্ক। কেউ বলছে এটা মহামারি আকার ধারণ করেছে, কেউ বলছে চিকুনগুনিয়া মহামারির ধারের কাছেও নেই। অথচ বিশ্লেষকরা বলছে, চিকুনগুনিয়া যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, যে পরিমাণ মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে তাতে এটা অব্যশই মহামারি। কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ আহমেদের মতে, “একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যখন হঠাৎ করে কোনো রোগে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় তখন তা মহামারি।” সেই হিসেবে আমি বলবো চিকুনগুনিয়াও মহামারি। সর্বোপরি যে কথা বলতে চাই, তা হলো- আমাদের নিজেদের নৈতিক গুনের মান উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দোষারোপ দেয়া পরিহার করতে হবে। হতে হবে আরো বেশি সচেতন এবং সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দুর্যোগে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে সমাজের বিত্তশালী মানুষদের ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে। সর্বশেষ প্রার্থনা করছি সৃষ্টিকর্তার কাছে বানভাসি মানুষ ও চিকুনগুনিয়াই আক্রান্তদের জন্য।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক কর্মী, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
অনফঁষধুরুৎঁ৩০৩@মসধরষ.পড়স