জমাট সার নিয়ে বিপাকে ডিলাররা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৭, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক



বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) রাজশাহী বাফার গুদামে মজুদ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিকটন জমাটবাধা ইউরিয়া সার। এছাড়া গুদামের বাইরেও রয়েছে আরো কয়েক হাজার মেট্রিকটন জমাট সার। এসব সার ডিলারদের দেয়া হচ্ছে প্রায় বাধ্য করেই। সার উত্তোলন করে বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চাষিরা এসব সার কিনছেন না। ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়েছেন ডিলাররা।
সংশ্লিষ্টরা ডিলাররা বলছেন, রাজশাহী বাফারের বাইরে খোলা অবস্থায় বিপুল পরিমাণ জমাট সার পড়ে রয়েছে। এসব সার বিতরণ করা হচ্ছে সারগুলির জমাট ভেঙে নতুন করে বস্তাবন্দির পর। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিলারদের মাঝে এসব সার বিতরণের কাজ চলছে। ডিলাররা আরো বলছেন, বোরো মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এখন সারের ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু জমাট সার তুলে বিক্রি করা যাচ্ছে না। একই পরিস্থিতির কথা জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাফার গুদাম সান্তাহার ও নাটোরের ডিলারদের কাছ থেকেও। উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিলাররা জেলা প্রশাসনকে জমাট  ইউরিয়া সার নিয়ে অভিযোগ দিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর সার ডিলাররা সভা করে জমাট সারের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। তারা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বিষয়টি।
এদিকে গত ২৩ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের দফতরের সার মনিটরিং কমিটির সভায় জমাট সার নিয়ে অভিযোগ করেন ডিলাররা। ডিলারদের অভিযোগের প্রক্ষিতে রেজ্যুলেশন করে তা কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হাসান। চিঠি পাঠানো হয়েছে বিসিআইসির রাজশাহী বাফার গুদামেও। তবে এখনো বন্ধ হয়নি জমাট সার বিতরণ।
জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫৮ জন ডিলার জমাট সার না নেয়ার জন্য সার উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন ডিলার নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাজশাহীতে যেসব জমাট ইউরিয়া পাঠানো হয়েছে সেগুলি ২০০১  সালে চিন ও অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা। এগুলি দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ১৪/১৫ বছর ধরে পড়েছিল। এখন এগুলি বিতরণের জন্য উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়েছে। আর একরকম জোর করেই ডিলারদের দেয়া হচ্ছে। এসব সার পুরোপুরি  নষ্ট বলে দাবি করছেন ডিলাররা।
রাজশাহী সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সচিব হাবিবুর রহমান জানান, গত কয়েক বছরে চিন থেকে আমদানি করা ইউরিয়া সারগুলো জমাট বেঁধেছে। গত জানুয়ারি থেকেই কমবেশি করে এ সার বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ডিলারদের। তবে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই বরাদ্দের ৪০ শতাংশ দেয়া হচ্ছে জমাট বাধা ইউরিয়া আর বাকি ৩০  শতাংশ করে দেয়া হচ্ছে কাফকো ও বিসিআইসির বল ইউরিয়া সার। ডিলাররা এসব জমাট সার নিয়ে গিয়ে কৃষকদের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না। আগেও জমাট বাধা ইউরিয়া নিয়ে বিপাকে পাড়েছিলেন তারা। বছর শেষে সেগুলো কম দামে মাছ চাষিদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এতে তারা বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
কৃষকদের বরাত দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ডিলার জানিয়েছেন, কৃষক জমাট বাঁধা সার বিক্রি করা যাচ্ছে না। মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় কর্মকর্তাদের উপরি দিয়ে ভালো সার নিচ্ছেন তারা। ভালো ইউরিয়া নিতে রাজশাহী, সান্তাহার ও নাটোর গুদামের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বস্তায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে বেশি দিতে হচ্ছে। যারা টাকা দিচ্ছেন তাদের পুরোটাই ভালো সার দেয়া হচ্ছে।
এদিকে গতকাল বুধবার দুপুরে রাজশাহী বাফার গুদামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গুদামের ভেতরে বিপুল পরিমাণ জমাট সার স্তুপ করে রাখা হয়েছে। জমাট বস্তাগুলি লোহার বাটাল দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা হচ্ছে। একদল শ্রমিক ভাঙছে আর একদল নতুন বস্তায় পুরছে। এসব সারই ডিলারদের দেয়া হচ্ছে। অনেক ডিলার জমাট বস্তা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা বিসিআইসির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছে হাতজোড় করে ভালো সার চাইছেন। আড়ালে গিয়ে সমঝোতার পর ভালো সার নিয়ে ট্রাকে তুলছেন। এসব বিষয়ে ছবি তুলতে গেলে বাফার ইনচার্জ আবু বকর সিদ্দিক বাধা দেন সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, ছবি তোলার অনুমতি নেই। তবে জমাট হলেও সারগুলির গুণগত মান ঠিক রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
তার ভাষায়, সর্বশেষ মাস ছয়েক আগে এগুলোর মান পরীক্ষা হয়েছে। তাতেই প্রমাণিত এগুলো এখনো ব্যবহার উপযোগী আছে। তারা এগুলো বস্তাবন্দির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ মৌসুমেই নতুন বস্তায় ভরে এসব সার ডিলারদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
তিনি স্বীকার করেন চিন থেকে আমদানিকৃত রাজশাহী বাফারে প্রায় ৫ হাজার টন জমাট সার মজুদ আছে। জমাট হলেও এগুলি ব্যবহার উপযোগী করে ডিলারদের সরবরাহ করা হচ্ছে। আর্থিক সুবিধা নিয়ে জমাট সারের পরিবর্তে ভালো সার দেয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন গুদাম ইনচার্জ। বাফারের কর্মচারি  কিবরিয়ার বিরুদ্ধে ডিলারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভালো সার দেয়ার অভিযোগটাই বেশি। তবে গতকাল  দুপুরে সাংবাদিকদের দেখে কিবরিয়া কিছু সময়ের জন্য গুদামের পেছনের দিকে গিয়ে নিজেকে আড়াল করেন। তবে সেখানেও ডিলাররা তার কাছে ভিড় করছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৮ হাজার  মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে রাজশাহী বাফারে  মজুদ  রয়েছে  প্রায় ১৪ হাজার মেট্রিক টন সার। গত জানুয়ারিতে বরাদ্দ এসেছে ১৪ হাজার মেট্রিকটন। এর পুরোটাই বিতরণ হয়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৩৭ জন ডিলারের মাঝে। ফেব্রুয়ারিতে বরাদ্দ রয়েছে ১৪ হাজার ৭০০ মেট্রিকটন। ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গুদামে এসেছে ৪ হাজার ৪১৯ মেট্রিকটন। আর ডিলার পর্যায়ে বরাদ্দ হয়েছে ২ হাজার ৫৪২ মেট্রিকটন। নগরবাড়ি, বাঘাবাড়ি, খুলনা ও ঢাকার  আমিনবাজার থেকে সার আসছে রাজশাহীর বাফার গুদামে। এখানে আসার আগেই বন্দরে পড়ে থাকছে অযতেœ।  আর জমাট বেধেছে সে কারণেই।
কৃষি বিভাগ বলছে  এ বছর কেবল রাজশাহীতেই বোরো  চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৯ হাজার ৪১২ হেক্টর। ধানের ভালো দাম পাওয়ায় বোরো আবাদ বেড়েছে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়। তবে সার নিয়ে ঝামেলায়  আবাদে বিঘœ ঘটছে বলে ডিলাররাই স্বীকার করছেন।