জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ

আপডেট: অক্টোবর ২৩, ২০১৬, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনের বিভিন্ন বিষয় তদারকি করার জন্য পুলিশ হেড কোয়াটার্সে একটি ইউনিট রয়েছে। যারা শান্তি রক্ষা মিশনে যাওয়া ও সেখানে কর্মরতদের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তদারকি করেন। তাদের কাজ, সুযোগ-সুবিধা, আয়সহ বিভিন্ন বিষয় তারা মনিটরিং করেন। ফলে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনের সকল বিষয় ওই শাখায় সংরক্ষিত আছে। মিশনের বিভিন্ন বিষয় তদারকি করার জন্য প্রায় সময় জাতিসংঘ থেকে বিভিন্ন সময় প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে পুলিশ হেডকোয়াটার্সে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে গাইড লাইন দেন।
বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের সক্ষমতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা পরীক্ষিত। আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের সময়ও বাংলাদেশ পুলিশ শান্তি প্রক্রিয়া থেকে পিছু পা হয়নি। বরং জাতিসংঘের চাহিদা অনুযায়ী মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শান্তিরক্ষীরা প্রতিদিন যেসব কাজ করে যাচ্ছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১. হামলার হুমকি থেকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করা,২. নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ৩. পুলিশ বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করা, ৪. নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠাসহ মানবাধিকার রক্ষা ও মানবাধিকারের ইস্যুটিকে জোরদার করে তোলা। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর ৪টি মহাদেশে ১৬টি  মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা নিজের জীবন বিপন্ন করেও দেশের পতাকাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও উজ্জ¦ল করার জন্য নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, যা এখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি স্থাপনে ‘ব্লু হেলমেট’ পরিহিত বাংলাদেশ পুলিশের শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের উদাহরণও কম নয়। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ পুলিশের ১৬ জন সদস্য জীবন বিসর্জন দিয়ে শান্তিরক্ষা ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মূল অংশিদার হিসেবে বাংলাদেশের গর্ব করার মতো ইতিহাস, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ শান্তি রক্ষায় পেশাদারিত্বের জন্য  বিশ্ববাসীর প্রশংসা ও অকুন্ঠ সমর্থন অর্জন করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মতো আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বাংলাদেশের রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার গর্বিত ও বড় অংশিদার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশকে আগামীদিনেও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা বরাবরই পুলিশ অবজারভার বা মনিটর হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু ফর্মড পুলিশ (ঋচট)  কন্টিনজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের যাত্রা শুরু হয় ২০০৫ সালের জুলাই মাসে। ৫ সদস্যের অগ্রবর্তী দল আইভরি কোস্টে পদার্পণের মধ্যে দিয়ে। আইভরি কোস্টে টঘঙঈও (টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঙঢ়বৎধঃরড়হ রহ ঈড়ঃব ফদরাড়রৎব) মিশনে বাংলাদেশের প্রথম ফমর্ড পুলিশ কন্টিজেন্ট হিসেবে ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে ১২৫ জন সদস্য গমন করেন। তারা আইভরি কোস্টের বুয়াক শহরে ইঅঘঋচট-ও (ইধহমষধফবংয ভড়ৎসবফ ঢ়ড়ষরপব টহরঃ) স্থাপন করেন।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন নংÑ ১৫২৮ এবং ২০০৫ সালের ২৪ জুন তারিখে গৃহীত রেজুলেশন নংÑ১৬০৯ মোতাবেক আইভরি কোস্টে জাতিসংঘের মিশন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বিভাগের (উচকঙ) সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কেন হল লুট এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব ড. ইফতেয়ার আহম্মেদ চৌধুরীর মধ্যে স্বাক্ষরিত সাক্ষ্য স্মারকলিপির গঙট (গবসড়ৎধহফধস ড়ভ টহফবৎংঃধহফরহম) মাধ্যমে বাংলাদেশ ফর্মড পুলিশ ইউনিট জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, যা ৫ অক্টোবর ২০০৫ সাল হতে কার্যকর বলে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশের প্রথম ফর্মড পুলিশ ইউনিট হিসেবে ইঅঘঋচট-ও আইভরি কোস্টে যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে। এর ফলশ্রুতিতে  টহরঃবফ ঘধঃরড়হং গরংংরড়হং রহ ঃযব উবসড়পৎধঃরপ জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঈড়হমড় (গঙঘটঈ), আইভরিকোস্ট, পূর্ব তিমুর, সুদান, দক্ষিণ সুদান, হাইতিতে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা ঋচট সদস্য হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং প্রশংসনীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছে এবং এখনও করছে।
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ আন্তর্জাতিক পরিম-লে কাজ করার সুযোগ লাভ করে। যার ফলে পুলিশ সদস্যদের মনোবল ও পেশাদারিত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আধুনিক কলা-কৌশল ও পুলিশি নীতিমালা সম্পর্কে মিশন সদস্যদের ব্যাপক ধারণা ও অভিজ্ঞতা লাভ হচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের নিকট হতে প্রতিটি ঋচট এর জন্য বৎসরিক প্রায় ২০ কোটি টাকা (ভাড়া ও ভাতাদি) পেয়ে থাকে যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করছে। এর মধ্যে বেতন-ভাতা, বিশেষজ্ঞ ভাতা ইত্যাদি খাতে বাৎসরিক প্রায় ১২ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। বাকি প্রায় ৮ কোটি টাকা অর্জিত হয় ফর্মড পুলিশ ইউনিটের সাথে প্রেরিত গাড়ি ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদির জবরসনঁৎংবসবহঃ  হিসেবে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েনকৃত ঋচট হতে প্রাপ্ত ভাড়া ও ভাতাদি ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি জীপ এর ভাড়া হিসেবে বাৎসরিক ৬৯৯৬ ডলার বা প্রায় ৪,৮৯,৭৮০ টাকা পেয়ে থাকেন।
র‌্যাব-৫ রাজশাহীতে চাকরিকালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একজন সদস্য হিসেবে আমি সহ সারাদেশ থেকে মোট ১৪০ জন সদস্য ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুদানের দারফুর প্রদেশের রাজধানী নিয়ালায় যাই এবং সেখানে আমাদের কন্টিনজেন্ট (ইঅঘঋচট-১) ১৪ মাস নিষ্ঠা ও সুনামের সাথে দায়িত্বপালন করে। ৫ মাস পর অবশ্য আমাদের একজন সদস্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশ ফিরে আসে। আমাদের মিশনের নাম ছিল টঘঅগওউ (টহরঃবফ ঘধঃরড়হ অভৎরপধহ ঐুনৎরফব গরংংরড়হ রহ উধৎভঁৎ)। দারফুর মিশনে চাকরির সময়টা আমরা প্রত্যেকেই খুবই উপভোগ করেছি। বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশের পুলিশ সদস্যরা একত্রে ছিলাম। আমাদের ক্যাম্পের পাশে চিন, পাকিস্তান, নেপাল, মিশর, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, বারকিনো ফাঁসোর ক্যাম্প ছিলো। আমরা সুপার ক্যাম্পের ভিতর সকাল-বিকাল জগিং করতাম। রাস্তায় বিভিন্ন দেশের পুলিশ সদস্যদের সাথে দেখা হলে হাই-হ্যালো করে সৌজন্য বিনিময় করতাম। এভাবে অনেকের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। চলে আসার সময় তারা অনেকেই কেঁদেছিলেন। প্রতি মাসে কোন না কোন দেশ আমাদের দাওয়াত করে খাওয়াতো। চিন এবং নাইজেরিয়ার রান্না আমরা খেতে পারতাম না। চিন একবার গাধা এবং আরেকবার কুকুরের মাংস রান্না করেছিলো। দাওয়াত করার সত্ত্বেও আমরা কেউ যায়নি। নেপালের ২০ জন নারী সদস্য ছিলো। তারা প্রায় গান বাজনার আয়োজন করত। নারী পুলিশ সদস্যরা নাচ, গানে ক্যাম্প মাতিয়ে তুলতো। সুশীলা নামে খুবই সুন্দরী এক নারী সাব-ইন্সপেক্টর নাচে-গানে ছিলেন সেরা। মিশনে থাকতেই তার কন্টিজেন্টের এক ইন্সপেক্টরের সাথে ক্যাম্পের ভেতরেই তার বিয়ে হয়। এ উপলক্ষে সুশীলা ও তার পুলিশ কর্মকর্তা স্বামী আমাদেরকে তাদের ক্যাম্পে আমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ফর্মড পুলিশ ইউনিটের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিক সংখ্যক ইউনিট বিভিন্ন মিশনে গমণ করেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ফর্মড পুলিশ ইউনিট মোতায়েনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের যে অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছে, তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে যেমন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সাথে সাথে পুলিশি কার্যক্রমের গুণগত মান ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ একটি অনুন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বশান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিশ্বসমাজে তার মর্যাদা ও সুনাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বে এক অনন্য স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশ পুলিশ আন্তর্জাতিক পরিম-লে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ইতিবাচক অবদান রাখছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশের সাফল্য ও গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিম-লে অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। মিশনে বেতন-ভাতা সহ সব কিছু আন্তর্জাতিক নিয়মে দেয়া হয়। যার ফলে পুলিশ সদস্যরা শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের জন্য যথেষ্ট সুনাম বয়ে আনছেন যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশ পুলিশের শান্তিরক্ষা মিশনের এ জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা (অব:)(আই.জি ব্যাজ, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত)