শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিকতায় এবার প্রকাশ্যে এসেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির। গত ২৯ অক্টোবর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি, সেক্রেটারি ও প্রচার সম্পাদক। তবে ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো নিয়ে এখনো দ্বিধাবিভক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো।
জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ১৫ আগস্ট ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রহমান কবির আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে তার উপর দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায় ছাত্রদলের আরেকটি গ্রুপ।
এর ধারাবাহিকতায় ২৬ আগস্ট মারা যান তিনি। এ ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে জাবিতে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রফ্রন্ট, সাংস্কৃতিক জোটসহ ক্যাম্পাসের সব সংগঠন মিলে শিবিরের বিরুদ্ধে ‘সর্বদলীয় ঐক্য’ গড়ে তোলে।
তবে ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির নেতারা। ২৯ অক্টোবর প্রকাশিত বিবৃতিতে তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ‘দীর্ঘদিন ধরে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ছাত্রশিবিরকে আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে নিষিদ্ধের একটি বয়ান তৈরি করে এসেছে। আদতে এই বয়ানের কোনো সত্যতা নেই।
১৯৮৯ সালের ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ১৪২তম সভায় শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাবনা এলেও এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।’ বরং সভার সিদ্ধান্ত ছিল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাবহির্ভূত বিধায় এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব নয়’।
এর প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে এক সভায় মিলিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। তবে সভায় ঐক্যমতে পৌছাতে ব্যর্থ হয় সংগঠনগুলো। পরে রোববার এক সংবাদ সম্মেলন করে ৪১ দফা উপস্থাপন করে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফিরলো ছাত্রশিবির।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশনের (জেইউডিও) সভাপতি প্রাপ্তি তাপসী বলেন, যেহেতু ৩৫ বছর ধরে ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারেনি, স্বভাবতই ছাত্রশিবির প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মনে কিছু জিজ্ঞাসা রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বর্তমান নেতৃবৃন্দের অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা প্রশ্নে দলীয় ভূমিকার জায়গায় ছাত্রশিবিরের অবস্থান এবং আদতেই ছাত্রশিবির- ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা লালন করে কি না- সেই সকল প্রশ্নের মীমাংসা ঘটিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার মাধ্যমেই একমাত্র তাদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সেক্রেটারি ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী বলেন, শিবির যদি ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে চায়, তাহলে তাদের পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। তারপরে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডাররা মনে করে শিবির রাজনীতি করতে পারবে, তাহলেই কেবল পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ছাত্ররা যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই চূড়ান্ত।
জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক ইয়াহিয়া জিসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ও সুস্থধারার রাজনীতির স্বার্থে শিবিরকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে স্বাগত জানাই। আমরা যারা ছাত্রলীগের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভোকাল ছিলাম, ছাত্রলীগ এবং যারা আমাদের অপছন্দ করতো তারা আমাদের অনেককেই শিবির ট্যাগ দিতো।
এখন শিবির প্রকাশ্যে আসায় এই ট্যাগিংয়ের খেলা বন্ধ হবে। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে ভাবছে, সেখানে কোনো ফ্যাসিবাদি মনন থাকবে না। শিবিরকে রাজনীতি করতে না দিতে চাওয়া মানে আপনিও ফ্যাসিবাদের অংশ হিসেবে মনে করছি। একটি গণতান্ত্রিক জাহাঙ্গীরনগর বিনির্মাণে শিবিরসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান করছি।
গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের মুখপাত্র ইমরান শাহরিয়ার বলেন, ক্যাম্পাসে অন্তর্র্বতীকালীন সময়ে সকল ধরণের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত রেখে ছাত্ররাজনীতির সংস্কার ও নতুন ছাত্রবান্ধব রাজনীতির প্রবর্তন প্রয়োজন। সেই রাজনীতি হবে সকল ছাত্ররাজনৈতিক দলের সহাবস্থানের ভিত্তিতে।
নতুন প্রবর্তিত সেই ছাত্ররাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তির কোনো স্থান থাকবে না এবং সেই ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতিতে সকল সংগঠন-ই তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করতে পারবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন জাবি শাখার সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়াম বলেন, আমাদের নতুন বাংলাদেশে সকল দলের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি চাই। ফ্যাসিবাদকে হটিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ছাত্রশিবিরকে বাদ দেয়ার সুযোগ নাই। আমরাও চাই ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফিরে আসুক। শুধু ছাত্রশিবিরকে নয় বরং সকল দলকে পূর্বের সকল বন্দোবস্ত ছুড়ে ফেলে দিয়ে; সকল অমীমাংসিত বিষয়ে দোষত্রুটি স্বীকার করে আসতে হবে। সামনের দিনগুলোতে তারা কীভাবে রাজনীতি করতে চায়, তার রূপরেখা হাজির করতে হবে, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতি হলো যুক্তি ও আদর্শের মাধ্যমে মতভেদ সমাধানের পথ; সহিংসতা বা গুপ্ত তৎপরতার নয়। হত্যা, নির্যাতন কিংবা মুখোশের আড়ালে রাজনীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; বরং সবার জন্য উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করাই প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে গোপনীয়তা ও সহিংসতা নয়, মুক্ত ও স্বচ্ছ রাজনীতি অত্যন্ত জরুরি। তাই তাদেরকে গুপ্ত তৎপরতা থেকে প্রকাশ্য রাজনীতি করতে দেওয়া উচিৎ।
ছাত্রশিবির সংবাদ সম্মেলন করার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে কি না তা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ. কে. এম. রাশিদুল আলম বলেন, তারা আমাদের কাছে আগে অনুমতি নেয়নি।
সাধারণত সংবাদ সম্মেলন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বা স্টেকহোল্ডারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয় না। এছাড়া ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনিকভাবে শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপনগুলো ঘাটলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে।’
তথ্যসূত্র: রাইজিংবিডি