জালিয়াতি

আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০১৭, ১১:৪৪ অপরাহ্ণ

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম



মৃতকে ‘জীবিত’ বানিয়ে জালিয়াতি। যারা দাতা তারাই ক্রেতা- এ শিরোনামে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর অনুসারে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সব সহায়-সম্পদ রেখে ভারতে চলে যান জনৈক ব্যক্তি। আট বছর পর সেখানে তার মৃত্যু হলে ঢাকায় থাকা ওই বিত্তশালীর ১৪১ শতাংশ জমি খাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছর পর উক্ত মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে জমিটি কৌশলে রেজিস্ট্রি করে নেয় একটি প্রভাবশালী চক্র। চক্রের সদস্যরা নিজেরাই দাতা, নিজেরাই ক্রেতা। নানা হাত ঘুরে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের এই সম্পদের মালিক বনে যান অপর এক ব্যক্তি। সেখানে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। অথচ আসল মালিকের উত্তরসূরিরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন- যা হতাশা এবং দুঃখজনক।
আরেকটি খবরে প্রকাশ, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারের অতিরিক্ত ৩৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একই জমির স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ দু‘বার ভূয়া বিল পেশ করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া জালিয়াতি করে জমির পরিমাণ বেশি দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়।
অন্য একটি খবরে প্রকাশ, বিধি ভেঙ্গে বিদেশি কোম্পানির টাকায় বিদেশ ভ্রমণ বৈধ করতে অবিশ্বাস্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানির এক কর্মকর্তা। প্রথম সরকারি আদেশের (জিও) বিপরীতে একটি বিদেশি কোম্পানির খরচে বিদেশ ভ্রমণ করে এসে ১৫ দিন পরের তারিখে স্বাক্ষরের মাধ্যমে নতুন আরেকটি জিও জারি করে আবারও বিদেশ ভ্রমণের বিল তুলেছেন কোম্পানির ওই কর্মকর্তা। সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের মতে, ‘কোন বিদেশি কোম্পানির টাকায় সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ নৈতিকতার পরিপন্থি ও বিধিসম্মত নয়। আগে এজন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। শাস্তির পর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ টাকা ফেরত নেয়ার বিষয়ও নির্ধারণ করতে পারেন’। জালিয়াতির মাধ্যমে কৌশলে অতিরিক্ত ভ্রমণ ভাতা তুলে নিতেই এই সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছে। কারণ দ্বিতীয় আদেশে ভ্রমণের ব্যয়ভার অংশে ‘বিদেশি কোম্পানি খরচ বহন করবে’ অংশটি বদলে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যয়ভার বহন করবে- বলে উল্লেখ করা হয়। জালিয়াতির এসব ঘটনা সুখকর নয়। এ ধরনের অসংখ্য জালিয়াতির ঘটনা সমাজে প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে। যার কিছু প্রকাশ পায়। তবে অধিকাংশ ঘটনা অজানাই থেকে যায়। আবার আইনের আশ্রয় নিয়েও অনেকেই সঠিক বিচার পায় না।  বাংলাদেশ দ-বিধির ৪৬৩ ধারা অনুসারে, যে ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির বা জনগণের ক্ষতি বা অনিষ্টসাধন কিংবা প্রতারণা করার অভিপ্রায়ে কোন মিথ্যা দলিল বা দলিলের অংশ বিশেষ প্রস্তুত করে সে ব্যক্তি জালিয়াতি করেছে বলে গণ্য হবে। কোন ব্যক্তির সাথে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি করা হয়। মালিকের অজ্ঞাতে জালিয়াতি করে সম্পত্তি প্রদান করতে বাধ্য করা হয়। জালিয়াতির ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির সম্মতির দরকার হয় না। জালিয়াতির শাস্তি দ-বিধির ৪৬৫, ৪৬৬, ৪৬৭, ৪৬৮ এবং ৪৬৯ ধারানুসারে হয়ে থাকে।
জালিয়াতির প্রকারভেদ : জালিয়াতিকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা-
১.  মুক্তহস্ত, অনুকরণ বা নকলকৃত জালিয়াতি,
২. ট্রেসিং জালিয়াতি,
৩. স্মৃতির সাহায্যে জালিয়াতি,
৪. নমুনা ব্যতিত জালিয়াতি বা অন্যের নামে জালিয়াতি।
জালিয়াতির রূপ:
১. অন্যের লেখা অনুকরণ করে লেখার মাধ্যমে,
২. অন্যের দস্তখত বা লেখা ট্রেসিং করে,
৩. মিথ্যা দলিলে এমন একজন তৃতীয় ব্যক্তির নাম লেখার মাধ্যমে যিনি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দস্তখত করেন, যার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
জালিয়াতির শাস্তি
দ-বিধি ৪৬৫ ধারা:- জালিয়াতির শাস্তি – ২ বছর কারাদ- বা অর্থদ- অথবা উভয় দ-।
দ-বিধি ৪৬৬ ধারা:- আদালতের নথিপত্র বা সরকারি রেজিস্টার ইত্যাদি জালকরণের শাস্তি – ৭ বছর কারাদ- তদুপরি অর্থদ-।
দ-বিধি ৪৬৭ ধারা: মূল্যবান জামানত, উইল ইত্যাদি জালকরণের শাস্তি- ১০ বছর কারাদ- তদুপরি অর্থদ-।
দ-বিধি ৪৮৬ ধারা: প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে জালিয়াতির শাস্তি:- ৭ বছর কারাদ- তদুপরি অর্থদ-।
দ-বিধি ৪৮৯ ধারা: মানহানির উদ্দেশ্যে জালিয়াতির শাস্তি – ৩ বছর কারাদ- তদুপরি অর্থদ-।
জালিয়াতির ঘটনা
পুলিশ ও র‌্যাবে চাকরিকরাকালীন অনেক জালিয়াতির ঘটনা দেখেছি, জেনেছি। আবার কোন কোন ঘটনা তদন্ত এবং তদন্ত তদারকি করেছি। পালিতপুত্র কর্তৃক এক বৃদ্ধার জমিজমা, ঘর-বাড়ি, জালিয়াতি করে আত্মসাৎ করার এমন একটি ঘটনা এখানে বর্ণনা করলাম।
জবেদা খালা। বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। চুল পেকে ধপধপে সাদা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। দাঁত ফোকঁলা, কবে সব দাঁত পড়ে গেছে তা তিনি নিজেও জানেন না। গায়ের রং মিশ মিশে কালো। হঠাৎ দেখলে অনেকেই ভয় পায়। মনে হয় যেন এক ডাইনিবুড়ি সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখলেই সকলে উল্টোপথে হাটা শুরু করে। কেউবা পাশ কেটে পালিয়ে বাঁচে। সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই। কথার জালে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। অথবা মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজিয়ে স্বার্থ হাসিল করে। আবির সেদিন তার সামনে পড়েছিলো। অনেক অনুনয় বিনয় করে ছাড়া পেলেও বাড়িতে আসতে না আসতেই শুনতে হয় নরম গরম অনেক ঝাঁঝাঁলো কথাবার্তা।
ঘটনা কি? বাড়িতে আসার আগেই জবেদা খালা এসে ইনিয়ে বিনিয়ে রংচং লাগিয়ে আবিরের বিরুদ্ধে কান ভাঙ্গিয়ে যায়। বলে সে নাকি তাকে দেখে সালাম দেয়নি। তার সাথে কথা বলতে চাইনি। কথা বলায় বিরক্ত বোধ এবং তাকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছে ইত্যাদি। অথচ আবির কিছুই করেনি। তাকে দেখে পাশ কাটার চেষ্টা করেছে মাত্র। এটাই তার অপরাধ, তাই এত কথা।
এই তো মাস দুয়েক আগে জবেদা খালা আবিরের মাকে বলে, সে না কি কলেজ বাদ দিয়ে গ্রামের রেহানার সাথে পার্কে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে সিনেমায় যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে কথা বলে ইত্যাদি। তাইতো কলেজ থেকে বাসায় ফিরতেই মায়ের সেকি বকাবকি, গালমন্দ শাসন-গর্জন। শুনেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে মনের দুঃখে সারারাত বিছানায় ছটফট করে জবেদা খালা মুন্ডুপাত করে।
সোহান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাশের প্রথম বয়, খুবই মেধাবী এবং ভদ্র। কিছুদিন আগে রাস্তায় জবেদা খালার সাথে তার দেখা। সালাম জানিয়ে পাশ কাটতেই জবেদা খালা খপ করে তার হাত ধরে ফেলে, এই তুই পালিয়ে যাস কোথায়? পালাচ্ছি না বলে সোহান জবেদা খালার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জোরে হাত ছাড়াতেই তিনি মাটিতে পড়ে কোমরে ব্যথা পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেন, ‘মরে গেলাম, কে কোথায় আছো আমাকে বাচাঁও। সোহান আমাকে মেরে ফেললো।’ তার মরণ চিৎকারে উপস্থিত অনেকেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। অধিকাংশই তাকে এড়িয়ে সরে পড়ে। কয়েকজন ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাকে তুলে সেবাযতœ করে। এ সময় তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, আজ সোহান আমাকে মেরে ফেলেছিলো। নির্ঘাত কপালের জোরেই বেচেঁ গেছি। তার বাবার কাছে এর বিচার দিয়ে তবে বাসায় ফিরবো। এই বলে তিনি সোহানদের বাসার উদ্দেশ্যে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান।
ঘটনা কিছুই না। জবেদা খালা প্রায় সোহান এবং তার বন্ধুদের জ্বালাতন করে। তাদের কাউকে ধরতে পারলেই তার কাছ থেকে পান, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি খাওয়ার জন্য টাকা আদায় করে। কেউ না দিলে তার বিরুদ্ধে বাবা মা, আত্মীয় স্বজন এমন কি পাড়ার বিভিন্ন লোকজনের কাছে কুৎসা রটিয়ে বলে সে খারাপ, বেয়াদব। গুরুজনদের সালাম দেয় না, সম্মানও করে ন্।া আর নালিশ করার সময় তিনি এতো সুন্দর অভিনয় করে কথা বলেন যাতে সবাই তার কথা বিশ্বাস করে বসেন। কথা বলার সময় তিনি কাঁদেন যা সবার অন্তর ছুঁয়ে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
সোহানদের বাসায় পৌঁছে তার বাবাকে পেয়ে জবেদা খালার সে কি কান্না। কান্নায় চোখ আর নাকের পানি একাকার। বুক ভেসে যায় তবুও কান্না থামে না। সোহানের বাবা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, তোমার ছেলে আজ আমাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। কেন? উত্তরে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন, সামনে পরীক্ষা তাই দেখা হতেই সোহানকে বলি, ঘোরাফেরা না করে মন দিয়ে লেখাপড়া কর। এই কথা বলাতে সোহান রেগে তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। তিনি চিৎকার করে বলেন, এখনই তোমরা এর বিচার করো। নইলে অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করবো। একথা শুনে ভয় পেয়ে সোহানকে ডেকে তার বাবা বেদম মারপিট করেন। মার খেয়ে সোহানকে কাঁদতে দেখে জবেদা খালার সেকি হাসি। খুশিতে তিনি আত্মহারা হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বাহিরে চলে যান। দেখে মনে হয় এই মাত্র তিনি বিশ্বজয় করেছেন। সোহানের কান্না দেখে বাসার সবাই দুঃখ পায়। এ কারণে অসুস্থ হয়ে সোহানকে ২/৩ দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়।
রফিক-শফিক দু ভাই। তারা পাড়ায় নতুন এসেছে। উভয়েই স্থানীয় কলেজের ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। তাদের বাবা স্থানীয় একটি ব্যাংকের ম্যানেজার। বাবার বদলি সূত্রে এই পাড়ায় তাদের আগমন। দু’জনাই চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে। কলেজ না থাকলে সারাদিন পাড়ায় টো টো করে ঘোরাই তাদের কাজ। নতুন এসেছে বলে অনেকের সাথে তাদের পরিচয় হয়নি। তাই জবেদা খালাকেও তারা চিনে না। একদিন কলেজ বন্ধ থাকায় দু’ভাই বেরিয়েছে পাড়া ঘুরে দেখার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে তারা চৌধুরীর আম বাগানের পাশে দিয়ে যাবার সময় জবেদা খালার সাথে দেখা হয়। এই তোরা কারা, কবে এই পাড়ায় এসেছিস? দু’ভাই গল্পে মশগুল থাকায় জবেদা খালার কথা শুনতে পায়নি। জবাব না পেয়ে জবেদা খালা পুনরায় তাদেরকে বলেন, এই তোরা আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? এবারেও তারা জবেদা খালার কথা শুনতে পায়নি। আর যাবে কোথায় ? কোন উত্তর না পেয়ে তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাগান্বিত হয়ে রুক্ষস্বরে চিৎকার করে বলেন, এই বাদরের দল তোরা কে ? কোথা থেকে এসেছিস ? আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন ? চরম বেয়াদপ দেখি।
জবেদা খালার রাগারাগিতে দু’ভাই হতচিকত হয়ে বলে, এই বুড়ি কে তুমি ?  আমাদের উপর রাগ করছো কেন? উত্তরে জবেদা খালা বলে, আমি কে জানতে চাস? একটু পরে টের পাবি। এই বলে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠে, কে কোথায় আছিস ছুটে আয়। দু’জন চোর চৌধুরীর বাগান থেকে চুরি করে আম পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে রফিক শফিক জবেদা খালাকে চিনে না। তার চিৎকারে লোকজন ছুটে এলে দু ভাই ভয়ে দৌড় মেরে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। লোকজন এলে জবেদা খালা তাদেরকে মিথ্যা বানিয়ে বলে পালিয়ে যাওয়া ছেলে দুটি চৌধুরীর বাগান থেকে আম চুরি করে পাড়ছিলো। এদিকে রফিক শফিক পালিয়ে ভাবতে থাকে, ধরা পড়লে অপমান অপবাদ তো আছে, উত্তম মধ্যম না খেয়ে ছাড়া পেত না। তাছাড়া আম চোর হিসাবে এলাকায় পরিচিত হয়ে উঠতো। সর্বনাশ কে এই বুড়ি ? পরে তারা জবেদা খালা সম্পর্কে জানতে পেরে তার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে।
আরেক দিন হয়েছে কি জবেদা খালার আম খাওয়ার শখ হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে তিনি আম বাগানে যান। ওই সময় রনি নামে পাড়ার একটি ছেলে বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। রনি এলাকার ভাল, ভদ্র এবং সৎ ছেলে বলে বেশ সুপরিচিত। লেখাপড়ার সাথে মানুষের উপকার করাই তার কাজ। এ কারণে এলাকার সবার সাথে তার সুসম্পর্ক। জবেদা খালাকে দেখে রনি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই জবেদা খালা বলে উঠে, এই রনি পালিয়ে যাচ্ছিস কেন? এ দিকে আয়। অগত্যা রনি পালাতে না পেরে জবেদা খালার কাছে এসে বলে চাচী ডেকেছো কেন? উত্তরে তিনি বলেন, গাছে চড়ে কাচা আম পেড়ে দে, আচার বানাবো। রনি বলে বাগান মালিকের অনুমতি নিয়েছো ? তিনি বলেন অনুমতি নেয়া আছে তুই পাড়। রনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাছে উঠে বেশ কয়েকটি আম পেড়ে দেয়। জবেদা খালা খুশি হয়ে রনিকে দোওয়া করে আম নিয়ে চলে যান। রনিও স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
রনি স্কুল শেষে বাসায় ফিরে দেখে, তার বাবা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রাগে গড় গড় করছে। ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করতেই তার বাবা তাকে শপাং শপাং করে লাঠি পেটা করে বলেন, তুই চৌধুরীর বাগান থেকে চুরি করে আম পেড়েছিস কেন?  হতচ্ছাড়া তোর কারণে চৌধুরীর লোকজন বাড়িতে এসে যা তা বলে গালাগাল দিয়ে চোর বলে অপমান করে চলে গেল। এ কথা শুনে রনির তো আক্কেলগুড়–ম। আরে সে তো জবেদা খালার অনুরোধে আচারের জন্য আম পেড়ে দিয়েছে। নিজের জন্য তো পাড়ে নি। অথচ সেই বুড়িই আম চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে চোর সাজিয়েেেছ। এ কথা শুনা মাত্রই সবাই আফসোস করে বলেন, আহারে যার জন্য চুরি করে সেই বলে চোর। পরে জানা যায়, জবেদা খালা আম নিয়ে বাসায় রেখে চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে উল্টো রনির বিরুদ্ধে বাগান থেকে আম পেড়ে চুরি করার অপবাদ দিয়ে নালিশ জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়। রনির মতো একজন ভাল ছেলেকে চোর বলে মিথ্যা বদনাম দেয়ায় সবাই জবেদা খালার প্রতি প্রচ-ভাবে ক্ষুব্দ। তারা এর বিহিত না করে ছাড়বে না। কিন্তু এতো কিছুর পর বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?  তাই জবেদা খালাকে এ ব্যাপারে কিছু বলার জন্য কেউ রাজি হয় না এবং সাহসও পায় না।
একদিন সকালে জবেদা খালার বাড়ি থেকে হৈচৈ এবং কান্নার শব্দ ভেসে আসে। কি হয়েছে জানার জন্য দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জবেদা খালা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কাঁদছেন। তাকে কাঁদতে দেখে সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে যান। কারণ তিনি এতটাই কঠোর প্রকৃতির যে কেউ কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি। ইতোমধ্যে সেখানে অনেক লোক জমায়েত হয়। জবেদা খালাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার পালিতপুত্র বাড়িঘর, জমিজমা জালিয়াতি করে নিজের নামে করে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তার কথা শোনেনি এবং বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। সারাদিন জবেদা খালা গ্রামের এর কাছে ওর কাছে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে কিছু করতে পারে না। তার পালিতপুত্র সন্ত্রাসী প্রকৃতির ছেলে বলে কেউ জবেদা খালার কথায় সায় দেয় না। তিনি থানাতে গেলেও কর্তৃপক্ষ দেখবো বলে আশ্বাস দিয়ে কিছুই করে না। এভাবে সারাদিন অভুক্ত থেকে জবেদা খালা তার বাড়িতে এসে দেখতে পান বাহিরের গেটে বড় একটি তালা লাগানো। পালিত পুত্র ছাড়া ইহজগতে জবেদা খালার আর কেউ নেই। কোন সন্তান না হওয়ায় স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে। জবেদা খালা এতিমখানা থেকে একটি ছেলেকে এনে লালন-পালন করে বড় করেন। বাড়িঘর ছাড়াও জবেদা খালা পৈত্রিক সূত্রে ১৫ বিঘা ধানি জমি পেয়েছিলেন। পালিত পুত্রই ওই জমি-জমা দেখাশুনা করত।
পরের দিন সকালে জবেদা খালাকে গ্রামে আর দেখা যায় না। কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারে না। পালিত পুত্রকে জিজ্ঞাসাবাদেও সে কোন সদুত্তর দিতে পারে না। জবেদা খালা সেই যে হারিয়ে গেছে, সপ্তাহ মাস, বছর পার হলেও আর তাকে কোথাও পাওয়া বা দেখা যায় না। অনেকেই আড়ালে চুপিসারে কানাঘুষা করে থাকেন এই বলে যে, জবেদা খালা হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার পালিত পুত্রের গোপন হাত রয়েছে। জবেদা খালার বাড়িঘর আত্মসাৎ করার জন্য হয়তো তাকে গুম করেছে বলেই অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ার এ ব্যাপারে আর কেউ অগ্রসর হয় না। কেউ কেউ এই বলে মন্তব্য করেন, জবেদা খালা তার বাড়িঘর, জমি-জমা কোন মাদ্রাসার নামে দান করবেন বলে জানতে পারায় পালিত ছেলে জালিয়াতি করে জমি-জমা, বাড়িঘর লিখে নিয়ে জবেদা খালাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে এবং পরবর্তীতে কৌশলে তাকে গুম করে তার পথের কাটা সরিয়েছে। জালিয়াতির ঘটনা আইনগতভাবে আর আলোর মুখ না দেখে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে।
জালিয়াতি সম্পর্কে জনগণকে অবশ্যই সচেতন হতে এবং এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনা প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে যা অজানাই থেকে যায়। অনেকেই আইনের আশ্রয় নেয়। আবার কখনো পত্র-পত্রিকায় এসব ঘটনা প্রকাশ পায়, তবে তা সামান্যই। দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতা জালিয়াতিকে উৎসাহিত করে। জালিয়াতির সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত পূর্বক কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। তবেই জালিয়াতি কমবে, নচেৎ নয়।
লেখক : পুলিশ কর্মকর্তা (অব.) (আই.জি ব্যাজ, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত)