রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
এখনো রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালি আদর্শ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়ে জটিলতা কাটেনি। অধ্যক্ষকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে কলেজে আসতে দেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। এই প্রতিবেদকে তিনি আরো জানান, কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষককে মান-সম্মানের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। অথচ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধেও রয়েছে ছাত্রীর শ্লীলতাহানিসহ ডজন খানেক অভিযোগ।
বর্তমানে তিনি অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে পড়েছেন এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদপ্রাপ্তির জন্য প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বেশ কিছুদিন থেকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে জবর দখল করে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে আছেন ওই কলেজের শিক্ষক সহকারি অধ্যাপক সিরাজুল হক। শুধু তাই নয়, স্বঘোষিত (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ দাবি করেও তিনি সাইনবোর্ড দিয়েছিলেন তার অফিস কক্ষের দরজায়।
এ নিয়ে ওই কলেজ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। শিক্ষকদের মধ্যে সবসময় মনোমালিন্য, হৈচৈ লেগেই আছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এমন অবস্থায় যে কোন সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ওই এলাকার সচেতনমহল ও কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক।
জানা গেছে, অধ্যক্ষ হওয়ার খায়েস সহকারি অধ্যাপক সিরাজুল হকের নতুন নয়। অধ্যক্ষকে বিব্রত, হয়রানি ও নির্যাতন করে আসছে অনেক দিন থেকেই। এ নিয়ে অধ্যক্ষ মো. জয়নাল আবেদীন ও সহকারি অধ্যাপক সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে পাল্টা-পাল্টি থানায় ও বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ হয়েছে। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে সহকারি অধ্যাপক সিরাজুল হক আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। পাশাপাশি অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনকে কলেজে ঢুকতে দেন না। অধ্যক্ষকে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকেন। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ কাটাখালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানা গিয়েছে। এছাড়াও সিরাজুল ইসলাম স্বঘোষিতভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট বসলেও কোন সুরাহা হয়নি। সেখানে কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে সিরাজুল হক উত্তেজিত ও মারমুখী আচরণ করেন বলে জানান কলেজের কয়েকজন শিক্ষক। এসময় সাধারণ শিক্ষকগণ নির্বাহী অফিসার মো. সোহরাব হোসেনের কাছে আবেদন করেন- অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন ও সিরাজুল হককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হোক। পাশাপাশি তদন্ত সাপেক্ষে তাদের দোষী-নির্দোষ প্রমাণের আগ পর্যন্ত ওই দুইজনকে বাদ দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চান সচেতন এলাকাবাসী এবং অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলী।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ খণ্ডনের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ অবস্থায় সিনিয়র ৫ জন শিক্ষকদের মধ্যে থেকে দায়িত্বগ্রহণের আহবান জানানো হয়। ভীতসন্ত্রস্ত শিক্ষকবৃন্দের কেউ এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হননি।
জানা গেছে, সহকারি অধ্যাপক সিরাজুল হকের নামে অনিয়ম ও ছাত্রীদের ওপর যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অন্তত ১০ জন ছাত্রীকে কু-প্রস্তাব দেয়ার। এমন অভিযোগ তুলেছিলেন কলেজের অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীরা। এসব নিয়ে একবার কাটাখালি পৌর মেয়র (তৎকালিন) আব্বাস আলী একবার সমাধানে বসেন।
তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন শিক্ষক সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে ছাত্রী শ্লীলতাহানিসহ কু-প্রস্তাবের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি একজন ছাত্রী সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত কলেজে আসেন না। তারপরও ঠিকমতো বেতন উত্তোলন করেন। সভায় হাজিরা খাতা বের করা হলে সেখানে তথ্য মেলে কলেজে না আসার। তিনি প্রায় ২০ দিনের বেশি কলেজে উপস্থিত হননি। সেই সময় অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন সহকারি অধ্যাপক সিরাজুল হকের পক্ষেই সাফাই গেয়েছিলেন। অথচ আজকে অনৈতিক সুযোগ পেয়ে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে পড়েছেন সিরাজুল হক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, সিরাজুল হক ওই কলেজের অধ্যক্ষ হন- যা তারা চান না। এমন অত্যাচারি, অবিবেচক এবং শিক্ষকদের প্রাণনাশের হুমকি দানকারি শিক্ষক অধ্যক্ষ দায়িত্ব পেলে কলেজের সম্মান ক্ষুন্ন হবে। এখানে স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্ভিক, বিচার-বিবেকবান ব্যক্তি অধ্যক্ষ হোক তারা কামনা ও প্রত্যাশা করেন। তারা আরো জানান, অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনের বাড়ি অনেক দূরে এবং সিরাজুল হকের বাড়ি কলেজ এলাকায় হওয়ায় তিনি প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।
এ ব্যাপারে সিরাজুল হক বলেন, ‘এলাকার লোকজন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী আমাকে এই সম্মান দিয়েছেন। তাদের অনুমতিক্রমেই আমি দায়িত্ব নিয়েছি। অধ্যক্ষ তার কু-কর্মের জন্য পালিয়ে থাকলে তো কলেজ চলে না। তাই স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব পালন করছি’।
এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন বলেন,‘আমাকে নিয়োগ দেয়ার পর থেকেই সিরাজুল হক বিভিন্ন সময়ে আমার সাথে বৈরী আচরণ করেন। সঠিক তদন্ত হলে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য নয় বলে প্রমাণিত হবে। তিনি বলেন, সিরাজুল হক আমাকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। যে কারণে আমি অভিযোগ দিয়েছি। তবে অন্যকোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সহ-সম্পাদক এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির (সাবেক) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন বলেন, বিএনপি সুষ্ঠু পরিবেশ ও শান্তি রক্ষাকারি দল। এই দল কখনো অবৈধ ও অনৈতিক কাজকে সাপোর্ট করে না। আর কেন্দ্রীয়ভাবে সতর্ক করা হয়েছে, দলের নাম ব্যবহার করে কোন ধরনের অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে বহিষ্কার করাও হয়েছে। তবে ব্যক্তি স্বাধীনতা সব সদস্যের আছে। তিনি কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করবেন না বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে পবা উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. সোহরাব হোসেন বলেন, বিষয়টি অবগত হওয়ার পর অভিযুক্ত শিক্ষক সিরাজুল হকসহ অধ্যক্ষ ও অন্যদের ডাকা হয়েছিল। তিনি কিভাবে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসলেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে পাঠানো হয়েছে।