টাকার জন্য মায়ের কাছে লিবিয়ায় জিম্মি ওয়াসিমের আকুতি ‘টাকা পাঠিয়ে তুমি আমাকে জান ভিক্ষা দাও মা’

আপডেট: জুন ২৭, ২০২৪, ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


‘মা তুমি আমাকে তারাতারি বের কর। এরা (মাফিয়া) আমাকে মেরে ফেলবে। ১৪ লাখ টাকা বাড়ির ভিটাটুকু বিক্রি করে হলেও দাও মা। তুমি আমাকে জান ভিক্ষা দাও মা।’
লিবিয়ায় মাফিয়াদের কাছে জিম্মি ওয়াসিম আলীর মা পেমেলা বিবি বুধবার (২৬ জুন) সকাল ১১টার দিকে রাজশাহী কোর্টে এসে এভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছিলেন। ওয়াসিমের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ৫ নম্বর ঝালুকা ইউনিয়নের সায়বাড় গ্রামের আব্দুর সাত্তারের ছেলে। ওয়াসিম দেড় বছর আগে লিবিয়া গেছে। এদিন (বুধবার) ওয়াসিমের মা পেমেলা বিবি ও মামা আব্দুল জলিল জিম্মি অবস্থায় থাকা ওয়াসিমের চাচাতো ভাই ইসমাইল ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগের তাদের ও তার পরিবারের নামে রাজশাহী কোর্টে অভিযোগ জানায়।

পরিবারের দাবি- ওয়াসিম আলী পাঁচমাস আগে লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে বন্দি হয়। ওয়াসিম আলীর মুক্তির জন্য ইতোপূর্বে তারা ৮ লাখ টাকা দিয়েছেন চাচাতো ভাই ইসমাইলের পরিবারকে। এই ইসমাইল আগে থেকেই লিবিয়াতে থাকে। তিনি ওয়াসিম আলীকে ইতালিতে পাঠানো এবং সেখানে অনেক টাকা উপার্জনের প্রলোভন দেয়। স্থানীয় হাসপাতালে কাজ বাদ দিয়ে ইসমাইলের পাঠানো গাড়িতে উঠে ওয়াসিম আলী। তার ১৫দিন পরে দেখে ওয়াসিমের বাড়িতে খবর আসে তিনি মাফিয়াদের হাতে জিম্মি। তাকে ছাড়াতে টাকা দিতে হবে।

লিবিয়ায় জিম্মি ওয়াসিমের মা পেমেলা বিবি বলেন, এই ঘটনার আগে একদিন মুঠোফোনে ইসমাইল বলে- ছোট মা আমরা যদি ওয়াসিমকে ইতালি পার করে দেয়, তাহলে ভালো। আপনারা গরিব মানুষ। আপনারা ভালো খাবেন, দেখে আমাদের ভালো লাগবে। আমি ইসমাইলকে বলি- বাবা আমার তো টাকা-পয়সা নাই। টাকা পয়সা লাগলে কোথা থেকে দেব। তখন ইসমাইল বলে- চাচি টাকা পয়সা অতো লাগবে না। আপনার কাছে যে টাকা আছে সেগুলোই দিয়েন। ওয়াসিমকে আমি পার করে দেব ইতালিতে। আপনারা চিন্তা করেন না।

ছেলের উদ্ধৃতি দিয়ে পেমেলা বিবি আরও বলেন, ছেলে বলেছে টাকা পাঠাও না হলে এরা আমাকে মেরে ফেলবে। এরপরে আমি লাভের উপরে টাকা (সুদে টাকা) নেয়। ছেলে বার বার বলে মা আমি তুমার থেকে জান ভিক্ষা চাই। তুমি টাকা পাঠাও। ৫ মাসের বেশি হয়ে গেলো কিন্তু সেই ছেলেকে আজও আমি মুক্ত করতে পারিনি। ইসমাইলের বাবা-মায়ের হাত পা ধরেছি। কোন কাজ হয়নি। আমি সরকারের কাছে দাবি জানায়, ছেলেকে সরকার সুস্থভাবে আমার বুকে ফিরিয়ে দিক।

ওয়াসিমের মামা আব্দুল জলিল বলেন, ওয়াসিম আর ইসমাইল সম্পর্কে চাচাতো ভাই। ওয়াসিমকে লিবিয়ার নিয়ে যাওয়ার শুরু থেকে ইসমাইল আছে। তার ভরসায় ওয়াসিম লিবিয়ায় যায়। সেখানে ইসমাইল ও ওয়াসিম একটা হাসপাতালে কাজ করছিল। এমন অবস্থায় ইসমাইল বার বার ওয়াসিমকে ফোন করে বলে তোমাকে লিবিয়ায় থাকতে হবে না। তোমাকে ইতালিতে পাঠাবো। সেখানে ভালো টাকা উপার্জন করতে পারবা। দীর্ঘদিন ফোন দিয়ে রাজি করে ওয়াসিমকে।

তিনি আরও বলেন, একদিন ওয়াসিমকে নিতে ইসমাইল গাড়ি পাঠায়। সেই গাড়ি যাওয়ার পরে আর যোগাযোগ ছিল না। ১৫ দিন পরে শোনা যাচ্ছে তাকে মাফিয়ারা আটক করেছে। তাদের হাত থেকে ছাড়াতে টাকা লাগবে। জায়গা জমি বিক্রি ও বন্ধকে রেখে সবমিলে ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। কিছু টাকা ইসমাইলের মা ও ভাই নিয়ে গেছে। গত কয়েকদিন আগে ভিডিও কলে মারধরের ভিডিও দেখানো হয়। আমরা কোর্টে ইসমাইলের মা-বা ও তার নামে অভিযোগ করেছি। তাদের আদালতে হাজির হওয়ার তারিখ ছিল গত মঙ্গলবার। কিন্তু তারা হাজির হয়নি। আজ হাজির হবে কি না বলা যাচ্ছে না।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে সায়বাড় গ্রামের মোস্তফার ছেলে ইসমাইলের বিরুদ্ধে। এই ইসমাইলের মাধ্যমে এলাকার ও আশেপাশের যারা গিয়েছে তারাও লিবিয়ায় গিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়। সর্বশেষ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকে ফিরেছেন সায়বাড় গ্রামের রহেদ আলীর ছেলে ইসমাইল। তিনি গত ৫ মাস আগে দেশে ফিরেছেন। এছাড়া বাসেরের মোড় এলাকার এক ছেলে লিবিয়ায় গেছে। তার বাবা-মা মোস্তফার ছেলে ইসমাইলের বাড়ি গিয়ে কান্নাকাটি করে।

ইসমাইলের চাচা মৌলভী ইসলাম বলেন, ভাতিজা ইসমাইলকে তারা লিবিয়ায় নিতে শুরু থেকে সহযোগিতা করেছি। তার ভাতিজাকে জিম্মি করা হয়েছিল। পরে স্থানীয়ভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়ে তাকে দেশে আনা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল আওয়াল মোল্লা বলেন, ৩ লাখ টাকা দেওয়ার দিনে তিনি ছিলেন। পরে আবার টাকা চেয়েছিল। তাদের দাবি ১২ লাখ টাকা। পরবর্তিতে টাকা দিয়েছে কিনা জানা নেই। তবে ইসমাইলের আরেক চাচাতো ভাই সেখানে থাকে; তাকে বললাম, বিষয়টা দেখার জন্য।

তিনি আরও বলেন, ওয়াসিমের বাবা-মা বলছে ইসমাইলেরা বিদেশে মানুষ নিয়ে গিয়ে আটকায়ে টাকা নেয়। এর আগেও করেছে। একই এলাকার মিলন ও ইসমাইলকে ৫২ দিন ধরে এইভাবে আটকে রাখে। বিষয়টি জানার পরে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে তাদের উদ্ধার করা হয়। বিষয়টা দুঃখজনক। আমরাও নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করছি, তারা রাজশাহী লিগ্যাল অফিসে অভিযোগ দিয়েছে।