মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সেলিম সরদার, ঈশ্বরদী (পাবনা) :২০২৩ এর ৩ সেপ্টেম্বর রাতে আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে এক প্রসূতি মা প্রসব ব্যথায় ছটফট করার সময় ট্রেনের টিটিই, নার্স ও যাত্রীদের মানবিকতায় এক নারীর চলন্ত ট্রেনে সন্তান প্রসব করার ঘটনা দেশ জুড়ে আলোচিত হয়েছিল।
এবার সেই একই ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়া এক কিশোরীর প্রাণ বাঁচাতে ট্রেনে কর্তব্যরত এক টিটিই’র আহবানে সাড়া দিয়ে টেনযাত্রীদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক, শিক্ষানবীশ নার্স ও কয়েকজন সাধারণ যাত্রী ছুটে এসে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকা থেকে নীলফামারি গামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে এ ঘটনা ঘটে।
ট্রেনে কর্তব্যরত সিনিয়র টিটিই আব্দুল আলীম মিঠু, অসুস্থ কিশোরীর চাচা মশিউর রহমান জানান, কলেজ ছাত্রী সুমনা আক্তার (১৯) এবছর এইচএসসি পাশ করার পর ঢাকায় চাচার বাসায় বেড়ানো শেষে ওই ট্রেনে চাচাসহ স্বজনদের সঙ্গে গ্রামে ফিরছিলেন। তিনি নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব চেংমারি গ্রামের মোক্তাহারুল ইসলামের মেয়ে। কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনটি ছাড়ার পরপরই কোমরে প্রচণ্ড ব্যথায় বমি শুরু করেন সুমনা।
ধীরে ধীরে ব্যথা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে হাত-পা অবশ হয়ে মূর্ছা যাচ্ছিলেন বারবার। তার এমন অবস্থায় সাথে থাকা কিশোরীর চাচা-চাচি পাগল প্রায়। ট্রেনে কর্তব্যরত টিটিই’র নিকট সহযোগিতা চাইলে সিনিয়র টিটিই আব্দুল আলীম মিঠুর আন্তরিকতা আর চেষ্টায় ট্রেনে থাকা কয়েকজন চিকিৎসক আর নার্স মিলে কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর সুস্থ করে তোলেন মুমূর্ষু কিশোরীকে।
ট্রেনের পিএ সিস্টেমের মাধ্যমে (ঘোষণাযন্ত্র) এ বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার পর ঘোষণা শুনে কয়েকজন যাত্রী যার কাছে যে ওষুধ ছিল তা নিয়ে হাজির হন ওই রোগীর পাশে। প্রেসার মাপার যন্ত্রের ব্যাপারে ঘোষণা দিলে সেটা নিয়েও হাজির হন একজন। প্রেসার মাপার পর ওষুধেরও প্রয়োজন হলো। কেউ নিয়ে এলেন ব্যথার ওষুধ, কেউ প্রেসারের। মেয়েটিকে সুস্থ করতে আসেন ট্রেনের যাত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত ডা. মো. ফাহিম উদ্দিন, সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. মো. শামসুল ইসলাম ও ডা. মো. নাজমুল হুদা ও একজন নার্স (নাম জানা যায়নি)।
চলন্ত ট্রেনে রীতিমত ‘মেডিকেল বোর্ড বসিয়ে’ চলছিল নানা উপায়ে ওই কিশোরীকে সুস্থ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা। চিকিৎসকরা গরম পানির সেক দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলে ক্যান্টিন থেকে বোতলে দ্রুত গরম পানি এনে সেঁক দেবার ব্যবস্থা করা হলো। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রেলওয়ে স্টেশনের মাইকে ঘোষণা দিয়ে কোন যাত্রীর কাছে সাপোজিটরি থাকলে সহযোগিতা চাওয়া হলো। কিন্তু ব্যথানাশক ট্যাবলেট থাকলেও কারো কাছে সেটা ছিল না। চিকিৎসক, নার্সসহ সবাই রোগীর সামনে বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। প্রায় ২ ঘণ্টা চেষ্টার পরও যখন রোগীকে সুস্থ করা যাচ্ছিল না তখন বড়ালব্রিজ স্টেশনে চিলাহাটী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রাবিরতি না থাকলেও ট্রেন পরিচালককে অনুরোধ করে ট্রেন ধীর গতি করিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করার পর রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সবাই।
ট্রেনে কর্তব্যরত সিনিয়র টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘মেয়েটির চাচা মশিউর রহমান ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কিনা সে ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে আমি তৎক্ষণাৎ যাত্রী সাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করে উচ্চস্বরে নিজ মুখেই ঘোষণা করি। পরে ট্রেনের পিএ সিস্টেমের মাধ্যমে মানবিক সাহায্য কামনা করলে একজন যাত্রী নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আসেন। পরে আরো দুজন চিকিৎসক, নার্স এগিয়ে আসেন চিকিৎসায়। ‘ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক জরুরি ওষুধগুলো সংগ্রহ করার জন্য আমি ট্রেনের পরিচালক বিশ্বজিৎ রায়কে অনুরোধ করি, বড়ালব্রিজ স্টেশনের বুকিং সহকারী মামুন হোসেনকে আগেই মুঠোফোনে ওষুধ কিনে রাখতে বলা ছিল।
বড়ালব্রিজ স্টেশনে ট্রেনটি ধীরগতি করিয়ে আগে থেকে স্টেশনে ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের নিকট থেকে সেই ওষুধ নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের হাতে বুঝিয়ে দিলাম। যাত্রীদের নিকট থেকে পাওয়া আগে গ্রহণ করা ওষুধ এবং পরে সংগ্রহ করা ওষুধ প্রয়োগের পর ধীরে ধীরে মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠে। মিঠু বলেন, ‘ট্রেনে এমন অনেক মানবিক ঘটনা ঘটে। অনেকে নানা রকম সমস্যায় পড়েন। আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা আমাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। এই মেয়েটির অসুস্থতার বিষয়টিও তেমনি একটি ঘটনা।
সুমনার চাচা মশিউর রহমান বলেন, ‘ট্রেনের টিটিই থেকে শুরু করে ডাক্তার, নার্স যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ালেন তাতে আমি সত্যি মুগ্ধ। এভাবেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সবার প্রতি আমাদের ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানাই।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত ডা. মো. ফাহিম উদ্দিন বলেন, ‘ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে আমরা তিনজন ডাক্তার ছুটে যাই। আমরা দায়িত্ববোধ থেকে মেয়েটির চিকিৎসা এগিয়ে গিয়েছি। আমাদের সঙ্গে সিনিয়র টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু, আমিরুল হক জাহেদী, এসি অপারেটর দীন ইসলাম, সৈয়দপুর জিআরপি থানার ইনচার্জ ফজলুল হক, ক্যান্টিন বয় রাকিবুল ইসলাম একজন নার্সসহ সবার আন্তারিক সহযোগীতায় মেয়েটিকে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে।