নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতিবছর লোকসান হলেও এবারও আম পরিবহনের জন্য চালু হচ্ছে ‘ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন’। এবার এই ট্রেন চালানো হবে পদ্মা সেতু দিয়ে। যমুনা সেতুতে ট্রেনের ধীরগতির কারণে শিডিউল বিপর্যয় এড়িয়ে দ্রুত ট্রেনটি ঢাকায় নিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ট্রেনে সহজে আম পরিবহনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রেলমন্ত্রী।
এবার নিয়ে পঞ্চমবারের মতো আবারও চালু হচ্ছে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন। ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে বিকেল চারটায় ছেড়ে রাত সোয়া দুইটায় ঢাকায় পৌছাবে। এই ট্রেনটি চালু হবে আগামী ১০ জুন থেকে। টানা চারবার লোকশান হয়েছিল এই ট্রেন চালিয়ে।
শনিবার (১১ মে) সকাল সাড়ে ১০টায় বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে ট্রেনে আম পরিবহন বৃদ্ধির লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর।
প্রতিবছর আম পরিবহনের জন্য এই ট্রেন দেওয়া হলেও চাষি ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহ কম থাকার কারণে লোকসানের বিষয়টি কর্মশালায় উঠে আসে। চাষিরা মতামত দেন, মূলত বাগান থেকে আম পরিবহন করে স্টেশনে নেওয়া এবং আবার স্টেশন থেকে আলাদা পরিবহনে মোকামে নেওয়ার বিড়ম্বনার কারণেই এই ট্রেনে চাষি ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহ কম। এই সমস্যার সমাধানে অতিরিক্ত স্টপেজ দেওয়াসহ আরও বেশ কিছু পরামর্শ দেন তারা।
সেমিনারে প্রধান অতিথি রেলপথ মন্ত্রী বলেন, ভোক্তা-আমচাষি ও আম ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে কম খরচে রেলপথে আম পরিবহন সেবা চালু করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। রেলপথ সবচেয়ে সস্তা পরিবহন। এর মাধ্যমে কম খরচে আম পরিবহন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আমের পরিবহন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন রেলমন্ত্রী।
রেলমন্ত্রী বলেন, অসুস্থ মানুষের পাশে কেউ না থাকলে সে বাঁচতে পারে না। আমরা (রেলওয়ে) এখন অসুস্থ। চাষি ও ব্যবসায়ীরা আমাদের পাশে থাকেন। আমরা আপনাদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে চেষ্টা করে যাব।
তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার দিন বলেছিলাম রেল লাভজনক হবে। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী চাষি ও ব্যবসায়ীদের কম খরচে আম পরিবহনের সুবিধা দিতে এই ট্রেন দিয়ে থাকেন।’
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা, নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদত আলী, রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মো. মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদারসহ রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, ফল গবেষক, কৃষি কর্মকর্তা, রেলওয়ের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁর আমচাষি এবং ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার।
মূল প্রবন্ধের আলোচনায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, বিভাগের ৪ জেলার গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদিত আমের পরিমাণ ছিল- চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৬২৫ মেট্রিক টন, নওগাঁ ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, রাজশাহী ২ লাখ ৬০ হাজার ৬ মেট্রিক টন, নাটোর ৭৭ হাজার ১৩৩ মেট্রিক টন। এছাড়াও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক, নওগাঁ ৪ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক, রাজশাহী ২ লাখ ৬০ হাজার ৩১৫ মেট্রিক, নাটোর ৭৬ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক।
তিনি আরো জানান, প্রথম ২০২০ সালের ৫ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী হয়ে রাজধানীগামী ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনটি চালু হয়। ঐ বছরের ২১ জুলাই পর্যন্ত চলা ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনে আম পরিবহন হয় ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৫ কেজি। এতে রাজস্ব আয় হয় ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩৬ টাকা। দ্বিতীয় বারের মতো ২০২১ সালের ২৭ মে ট্রেনটি চালু করা হয়। সেই বছর আম পরিবহন করা হয় ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৯২০ কেজি। রাজস্ব আদায় হয় ৩৬ লাখ ৩০ হাজার ৯২৮ টাকা। তৃতীয় বারের মতো ২০২২ সালে এ ট্রেনে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৭৮ কেজি আম পরিবহন করা হয়। এতে ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৪ টাকা আয় হয়। সর্বশেষ গতবছর ২০২৩ সালে এ ট্রেনে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০৬ কেজি আম পরিবহন করা হয়। এতে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫০২ টাকা আয় হয়। বিগত চার বছরে মোট ৩৯ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৮ কেজি আম পরিবহন হয়েছে এবং রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৬ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ টাকা।
তিনি আরও জানান, ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের ছয়টি লাগেজ ভ্যানে (পণ্যবাহী বগি) পণ্য পরিবহন করা হবে। প্রতিটি লাগেজ ভ্যানে ২৮.৮৩ টন করে মোট ১৭২.৯৮ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে। রাজশাহী থেকে রেলপথে প্রতি কেজি আম পরিবহনে খরচ পড়বে মাত্র ১ টাকা ৪৩১ পয়সা। যেখানে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতি কেজি আম পরিবহনে খরচ পড়ছে ১২-২০ টাকার মতো। এ সার্ভিস সফলভাবে পরিচালনা করতে জেলায় জেলায় মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সভা করে প্রচারণা চলছে। গত চার বছর যাবৎ চলছে এ সার্ভিস।
সেমিনারে থেকে জানা গেছে, ছুটি ছাড়াই সপ্তাহের প্রতিদিন বিকাল ৪টায় গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর স্টেশন ছেড়ে জেলার নাচোল, নাচোলের নিজামপুর, জেলার সদর উপজেলার আমনুরা জংশন হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশন, এরপর সদর উপজেলার আমনুরা বাইপাস, রাজশাহীর কাঁকনহাট হয়ে সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে রাজশাহী স্টেশন ছেড়ে রাত ৭টা ৩০ মিনিটে জয়দেবপুর, রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা এয়ারপোর্ট ও রাত ১টা ১৫ মিনিটে শেষ গন্তব্য ঢাকার তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছায়। আরেকটি ট্রেন রাত ৩টায় ঢাকা ছেড়ে পরের দিন দুপুর ২টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পৌঁছাবে। ট্রেনটি রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছাবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এবং ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাবে রাত সোয়া ২টায়। আম নামিয়ে রাতেই ট্রেনটি আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাবে।
রেলপথে গত চার বছর যাবত ঢাকায় আম পরিবহন করছেন পবা উপজেলার আম ব্যবসায়ী রবিউল আউয়াল। তিনি ও ট্রেনে আম পরিবহনকারী অন্য ব্যবসায়ীরা বলেন, সার্ভিসটি কুরিয়ারের চেয়ে ভালো ও সাশ্রয়ী। কুরিয়ারে কখন আম পৌঁছবে তা নিশ্চিত নয়। এছাড়া আম যত্নে যায় না। তবে তারা ফোন করে খবর দেয়। এছাড়া ট্রেনের আরেকটি সমস্যা শুধু শুরুর ও শেষের দুই স্টেশন পর্যন্ত আম আনা ও নেওয়ার বাড়তি বিষয়টি। তবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, অনলাইন আম ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে সার্ভিসটি ভালো।