সোনার আশায় মাটি খুঁড়ছে মানুষ
সোনার দেশ ডেস্ক :
‘লোকেমুখে শুনলাম এখানে মানুষ সোনা পাইতেছে, তাই আমিও খুঁড়তে আসছি’, বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার বাসিন্দা মহন্ত কুমার।
এ রকম শোনা কথায় ভর করে গত বেশ কিছু দিন ধরেই সোনা খুঁজতে ওই এলাকার একটি ইটভাটায় এসে ভিড় জমাচ্ছিলেন শত শত মানুষ।
অবশেষে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে। তাতে ভিড় কমেছে, কিন্তু আলোচনা থামেনি।
ঘটনার শুরু যেভাবে
ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার কাতিহার বাজার এলাকায় অবস্থিত আরবিবি ইটভাটা। ইট তৈরির জন্য মাসখানেক আগে সেখানে বাইরে থেকে মাটি নিয়ে আসেন ভাটা কর্তৃপক্ষ। তারপরই হঠাৎ করে জানা যায় সেই মাটি থেকে মিলছে স্বর্ণের সন্ধান।
“কেউ হয়তো শুরুর দিকে একটা টুকরা পেয়েছে কিন্তু স্বীকার করছে না। কিন্তু আসলে যতটা না ঘটনা, রটেছে তার চেয়ে অনেক বেশি,” বলছিলেন রাণীশংকৈল উপজেলার নির্বাহী অফিসার রকিবুল হাসান।
তবে তিনি জানান এখনও পর্যন্ত নিজের চোখে মাটিতে কাউকে স্বর্ণ পেতে দেখেননি তিনি।
তবে কি আসলে এই মাটি থেকে স্বর্ণ পাওয়ার ব্যাপারটা পুরোটাই গুজব? অনেকে অবশ্য তা মনে করেন না।
সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক ফাতেমা তু ছোগড়া যেমন নিজের চোখে একজনকে মাটিতে কিছু একটা পেতে দেখেন।
“একজন আমার সামনে পেল, কিন্তু ওটা কি সোনা না পিতল পরীক্ষার উপায় নেই, দেখেই দৌড় দেয়, কেউ কথা বলতে চায় না,” বলছিলেন তিনি।
সেখানকার ইউএনও নিজেও জানালেন কেউ কিছু স্বীকার করতে চাইছে না। কিন্তু এটার শুরুটা হল কীভাবে?
রকিবুল হাসান বলেন, “এখানে মাটি আনা হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু মাসখানেক আগে কাজ করতে গিয়ে এখানকার শ্রমিকদের কেউ হয়তো দু’একটা স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে থাকতে পারে।”
“তারপরই সবখানে রটে যায় যে এখানে মাটি খুঁড়লে স্বর্ণ পাওয়া যাচ্ছে।”
প্রথমে অল্প কিছু লোক আসলেও, আস্তে শত শত বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসে মাটি খুঁড়তে শুরু করে।
মাঝে কিছু দিন বন্ধ থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে ভিড় আবারও বাড়তে শুরু করে, এমন কী আশপাশের জেলা থেকেও অনেকে চলে আসে স্বর্ণের আশায়।
নারী, পুরুষ ও শিশু যে যা হাতের কাছে পেয়েছে সেটি দিয়ে সমানে দিনরাত মাটি খুঁড়তে থাকে।
১৪৪ ধারা জারি করতে হল কেন?
পরিস্থিতি সামাল দিতে শনিবার রাতে এই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ইটভাটায় মাটির স্তুপ খুঁড়ে সোনা পাওয়া যাচ্ছে মর্মে স্থানীয় লোকজনসহ আশেপাশের অসংখ্য লোকজন বেশ কিছুদিন যাবত খুন্তি, কোদাল, বাশিলা ইত্যাদি দিয়ে মাটি খুঁড়ে প্রতিদিন উক্ত স্থানে সোনার সন্ধান করছে। এতে আগ্রাসী লোকজন স্বর্ণ পাওয়ার আশায় ঝগড়া, বিবাদ, কলহ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে।”
এ নিয়ে সেখানকার ইউএনও বিবিসিকে বলেন, “প্রথম দিকে অল্প কিছু লোক ছিল, ধীরে ধীরে গত ৫-৭ দিন ধরে অনেক বেশি লোক আসতে থাকে। পরিস্থিতির কোনও অবনতি হয়নি, নিয়ন্ত্রণেই ছিল, আমরা পর্যবেক্ষণ করছিলাম, কিন্তু পরে দেখলাম এত বেশি লোক জমে যাচ্ছে ওটা ব্যবসাক্ষেত্র হয়ে যাচ্ছে।”
১৪৪ ধারা জারির পর অবশ্য পরিস্থিতি পুরোপুরি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরো ইটভাটা সকাল থেকে ফাঁকা, আর কোনও লোককেও আসতে দেওয়া হয়নি সেখানে।
এখন খোঁড়াখুড়িতে রাস্তায় উঠে আসা মাটি ইটভাটার ভেতরে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।
কারো সোনা পাওয়ার প্রমাণ না থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে নানান পোস্ট দেখা যায় এটি ঘিরে।
“গুজব শুনলাম কেউ ইমিটেশনের গহনা ছিটিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে।”
“এরকমও শোনা যায় আগের দিনের ব্যবহৃত তামাক পানের কল্কি সেখানে ফেলে দিয়ে কেউ পোস্ট দিয়েছে, ৭০ লক্ষ টাকার সোনা পাইলাম, আদতে সেটা পিতলের মতো একটা, উনি ছিটিয়ে দিয়ে ভাইরাল করেছে,” হাসতে হাসতে বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান।
তবে মি. বকুল মনে করেন, কেউ না কেউ কিছু একটা সেখানে পেয়েছে, না হলে এত ভিড় কখনওই হত না।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কী বলছে?
জায়গাটিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটা দল আসে। তারা মাটি পরীক্ষা করে দেখে সেখানে খনি বা এরকম কিছু নেই।
রকিবুল হাসান বলেন, “মাটিটা যে জায়গায় খনন করা হয়েছে সেটা কিন্তু একটা ধান ক্ষেত। কিন্তু আগে এটা হিন্দুদের মন্দিরের নিকটবর্তী কোনও মেলার জায়গা হয়ে থাকতে পারে। ধারণা করা হয় ব্রিটিশ পিরিয়ডে পুজার সময় এখানে হয়তো অনেকে মানত করে কিছু দান করতে পারে।”
অনেকটা একই মত সাংবাদিক ফাতেমা তু ছোগড়ার।
“এখানকার কংকনাথ জমিদারবাড়ির পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করে এখানে আনা হয়। সেজন্য মানুষের ধারণা যে তাদের পুঁতে রাখা গুপ্তধন এই মাটিতে থাকতে পারে,” বলেন তিনি।
আসলে কয়েকটা জায়গা থেকে ইট তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে এই ভাটায় মাটি আনা হয়।
“কিছু মাটি মন্দিরের পাশ থেকে, আবার কিছু পুকুর থেকেও আনা হয়েছে”, জানান সাংবাদিক বকুল।
“কষ্টিপাথর পাওয়া যায় ওরকম কিছু হয়তো কয়েন পেয়েছে, কারণ অনেকে সোনার পয়সা দান করত। এখন যে জায়গা থেকে মাটি আনছে ওর সাথে চলে আসছে”, বলেন তিনি।
তবে ১৪৪ ধারা জারির পর এই ইটভাটায় স্বর্ণপ্রত্যাশী মানুষের আসা বন্ধ রয়েছে। সেখানে বুলডোজার মাটি সরানোর কাজ চলমান।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা