চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:
বাড়ির সামনে ডাবের খোসার বিশাল স্তুপ। প্রথম দেখায় মনে হবে, এখানে রয়েছে বিশাল ডাবের আড়ৎ। কিন্তু এখানকার আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে হয় না ডাবের উৎপাদন। এমনকি নেই ডাবের কোন আড়ৎ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের ধরইল দিঘীপাড়া গ্রামের ‘ডাববাবা’ খ্যাত চিকিৎসক আমিন কর্মকারের বাড়ির সামনের চিত্র এটি। দীর্ঘদিন যাবৎ ডাবের পানি পড়া দিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করানোর পর বাড়ির উঠানে জমা হয়েছে এসব ডাবের খোসা।
পেশায় কামার হলেও এখন ‘ডাববাবা’ নামে পরিচিত আমিন কর্মকার। গত কয়েক বছর ধরে এলাকায় ফুঁ দেয়া ডাবের পানি খাইয়ে চিকিৎসা করান পাইলস, যৌন-দুর্বলতা, কিডনিতে পাথরসহ বিভিন্ন জটিল রোগের। আমিন কর্মকারের দাবি, চিকিৎসাপত্র, রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে বা আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়াই মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সুস্থ করে দেন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিডনির পাথর ডাবের পানি খাওয়ার সাথে সাথেই পড়ে যায়, তা প্রমাণ করতে আমিন কর্মকারের বাড়ির সামনে রাখা রয়েছে বাঁশের খুঁটি। যেখানে ডাবের পানি খাওয়ার পর প্রসব জমিয়ে পলিথিনে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফুঁ দেয়া ডাবের পানি খেলেই সব রোগ সেরে যায়, এমন কুসংস্কারে ভরসা রেখে দূর-দূরান্ত থেকে ডাব নিয়ে হাজির হন রোগীরা। এই অপচিকিৎসায় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন রোগীরা।
নিজের ভাইয়ের শাশুড়িকে কিডনিতে পাথরের রোগী নিয়ে আসা স্বজন আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পিরোজপুর গ্রামে। কয়েক জায়গায় ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু ডাক্তাররা জানিয়েছে, এটি অপসারণ করতে হবে। অন্যদিকে, এলাকায় আমিন কর্মকারের কথা শুনেছি। তার দেয়া ডাবের পড়া পানি খেলেই কয়েক ঘণ্টায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তাই কয়েকটা ডাব সঙ্গে নিয়ে এসেছি তার কাছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আষাড়িয়াহদহ গ্রামের আমিনুল ইসলাম জানান, মেয়ের জন্ডিসের চিকিৎসা করানোর জন্য ডাব বাবার কাছে এসেছি। তার ব্যাপারে অনেক শুনেছি, ডাবের পানি খেলেই নাকি অনেক রোগ সেরে যায়।
কাকনহাট এলাকার যুবক সিফাত রানা জানান, আমি এখানে কোন চিকিৎসা নিতে আসিনি। এলাকায় তার (আমিন কর্মকার) বিষয়ে ডাবের পানি দিয়ে চিকিৎসা দেয়ার কথা অনেক শুনেছি। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত মনে হয়েছে। তাই শুধুমাত্র ডাব দিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগী সারানোর উপায় দেখার জন্য এখানে এসেছি।
স্থানীয় বাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন জানান, কয়েক বছর ধরেই তিনি ডাবের পানি দিয়ে এমন চিকিৎসা প্রদান করছেন। আগে কামারের কাজ করলেও এখন তিনি পুরোদস্তর চিকিৎসক বনে গেছেন। তার কাছে মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে দূর দূরান্ত থেকে। এ ডাবের পানি দিয়ে চিকিৎসা করে তিনি এখন অঢেল সম্পত্তির মালিক। ডাবের পানিতে মানুষ সুস্থ হয় কী না জানি না, তবে অনেকেই চিকিৎসা নিতে আসতে দেখি।
কামার থেকে চিকিৎসক হওয়া আমিন কর্মকার এই অপচিকিৎসা করেই সরকারি খাস জমিতে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। প্রতিদিন ভোর থেকেই বিভিন্ন যানবাহনে ডাব নিয়ে আসতে শুরু করে রোগীরা। তবে তার দাবি, ফুঁ দিয়ে নয়, ডাবের পানির সাথে গাছ-গাছড়া দিয়ে করেন চিকিৎসা। কিন্তু তা দেখতে চাইলে না দেখিয়ে চলে যান তিনি। এমনকি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি। পাশাপাশি চিকিৎসা পদ্ধতি দেখতে চাইলে না দেখিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন।
‘ডাববাবা’ আমিন কর্মকারের সহকারী জহুরুল ইসলাম বলেন, তার বাপ-দাদাও একই উপায়ে দিয়েছেন চিকিৎসা। জন্ডিস, কিডনিতে পাথর, যৌন দুর্বলতাসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন ডাবের পানি দিয়ে। এমনকি বেশিরভাগই রোগী ডাক্তারের কাছে সুস্থ না হয়ে এখানে আসেন বলে দাবি তার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কবিরাজের বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ‘মার্কেটিং অফিসার’রা আগত রোগীদের কনভেন্স করে বলেন, তাদের রোগী আছে। ডাবপড়া পানি খেয়ে পিত্তথলি থেকে পাথর বের হয়েছে। রোগীদের এ ধরনের মুখরোচক গল্প শোনানো হয়। সাংবাদিক পরিচয় জেনে আর কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
বাংলাদেশে এমন ডাবের পানি পড়া দিয়ে জটিল রোগের চিকিৎসা অপরাধ বলে জানান নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ডাববাবার কাছে চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হওয়া মানুষকে আলট্রাসোনোগ্রাম করার পর কিডনিতে পাথর পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। মুখরোচক প্রচারণার মাধ্যমে এই প্রতারণা করে গ্রামের সহজসরল মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন আমিন কর্মকার। এমন অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।