সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১০ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সুজিত সরকার
নারায়ণগঞ্জ পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের পক্ষে তাদের সমর্থক তার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে নারায়ণগঞ্জবাসী। এই ধারা, একই সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার মূল্যটাকেও সর্বোচ্চভাবে মূল্য দিতে হবে নেতা-নেত্রীদের। না হলে তারাই কর্তৃত্ব হারাবেন। দেশ পুনরায় নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এবং লুটেরাদের খপ্পরে পড়বে। জনজীবন হবে বিপন্ন। তাই নেতা-নেত্রীদেরই মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসার মূল্য দিতে হবে তাদের সারিতে নেমে এসে। আমার বিশ্বাস ডা. আইভী পিতার মতো জনগণের সারিতে ছিলেন এবং তাদের আকাক্সক্ষাটা অনুধাবন করতে পেরে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন বলেই তিনি পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। এ ধারা প্রমাণ করে দেশে কেবল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার, আল-বদররাই নেই, তাদের চেয়ে অধিক সংখ্যক রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল মানুষ।
হয়তো তারপরও অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে কেনো নাসিরনগর ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সরকারি দলের নেতাদের আক্রমণের শিকার হলো? এ প্রশ্নের খুব সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর, ধান-পাট চাষ করলে কিছু আগাছা দেখা দেয়। ভালো উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষক সেই আগাছা নির্মূলে নিড়ানি দেয়। তখন আগাছাগুলো নির্মূল না হলেও খানিকটা দমন হয়। পরে তারা মাথা তুললেও ধান-পাটের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না। সরকারি দলকে আগাছামুক্ত করতে হলে এই নিড়ানি দিতে হবে। ওরা সংখ্যায় খুব কম। তার শত গুণ বেশি শান্তিপ্রিয় মানুষ। শান্তিপ্রিয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এগোলে দলের ভেতরের আগাছা মুহুর্তের মধ্যে মুক্ত হবে। ধর্মান্ধরা চিরকালই দুর্বল এবং ভীতু। মানবতা বিরোধীরাও তাই। আর সে কারণেই তারা জনগণের শক্তিকে ভয় পায়। একাত্তরে পরাস্ত হয়ে ভয়ে ওরা গর্তে লুকিয়েছিলো। দলের ভেতরে পুনর্বাসিত এবং আশ্রয়লাভকারীরাও ভীষণ নিঃসঙ্গ আর ভীতু। তাদের মন সব সময়ই পালাই পালাই চিন্তায় উ™£ান্ত থাকে। তারা যেখানেই অবস্থান নিয়েছে, সেখানেই তাদের স্বার্থ, ভোগ-বিলাসিতা পূরণের লক্ষ্যে সুযোগ নিয়েছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তারা জনগণকে ভুল বুঝিয়েছে। ধর্মকে তাদের স্বার্থ চরিতার্থের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। সম্পদে মালিকানা প্রতিষ্ঠা আর প্রভূত্ব কায়েমের লক্ষ্যে তারা দূর অতীত থেকেই এমন করে ব্যাখ্যা দিয়েছে। দুর্বলের ওপর আঘাত হেনেছে। যতোবার তারা এই দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ছে, ততোবারই সচেতন জনগণ জীবন দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেছে। করেছে পরাজিত। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই সুবর্ণ সময়ে নিরস্ত্র মানুষ কেনো বার বার ওই মানবতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। বরং তাদের উত্থান ও অপকর্ম যাতে বারংবার না ঘটে তার প্রতিষেধক হিসেবে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণের সরকারকেই সে দায়িত্ব নিতে হবে। নতুবা নেতাদের ভুল এবং লোভের কারণে ওরাই হবে দেশের পরিচালক। তাই আজকে নেতাদেরই সকল অশুভ-অপশক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা একদিন তাদের অস্তিত্বটাই বিপন্ন হবে। জনগণও নানা ধরনের শোষণ-নির্যাতন আর অবহেলার শিকার হবে। ডা. আইভীকেও সচেতন নাগরিকমাত্রই এ পরামর্শ দেবেন। আর তাদের প্রত্যাশা, তিনি জনগণের পাশে থেকে তাদের পরামর্শে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনকে পারিচালনা করবেন। জনগণের ভালোবাসা-বিশ্বাস ও আস্থার মূল্য যে নেতা দিতে পারেন না তিনি সত্যি হতভাগা।
অনেক নেতা জনকল্যাণমূলক কাজ করলেও তিনি দলের সুযোগসন্ধানী ও প্রভূত্বকামী নেতা-কর্মীদের কারণে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার অনেক দৃষ্টান্ত কেবল ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ নেই, সমকালের মানুষের অভিজ্ঞতায়েও জমে আছে। ওদিকে বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে অনেকটা বে-সামাল মন্তব্যও করছেন। গয়েশ্বর রায় বলেছেন, ‘নির্বাচন ফেয়ার ছিলো। বাট ফলাফল আনফেয়ার।’ রিজভী বলেছেন, সাংবাদিকদের কাছে গণনার পূর্বে বলেছেন, ফলাফল জেনে নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ফলাফল জানা পর তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি’র প্রার্থী পরাজিত হলেও ভোটের অঙ্কে এতো ব্যবধান হওয়ায় ভেতরে কিছু সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বলে মনে হয়।’ তাই তিনি বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। খোদ প্রার্থীও সে দাবি জানিয়ে বলেছেন, ‘বাহ্যিক সুষ্ঠু নির্বাচনের বাতাবরণ সৃষ্টি করে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।’ বিজয়িনী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পরাজিত প্রার্থীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে আবার প্রার্থী ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আইভী তার অনেক দিনের পরিচিত। পরাজয় মেনে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে তিনি আইভীর সঙ্গে কাজ করবেন।’ এই সব অসংলগ্ন কথাবার্তায় মনে হয়েছে, বিএনপি এখন বেসামাল। তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও শক্তির অভাবে যে তারা পরাজিত হয়েছেন, সে কথা কিছু নেতা উপলব্ধি করেছেন। আসলে বাংলাদেশে কেবল নয়, বিশ্বের সকল দেশে পরাজিত প্রার্থী নিজেকে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই তো ক’দিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উভয় প্রার্থীই যে অসংলগ্ন এবং অরাজনীতিক সুলভ কথা বলেছেন, তা একজন ছিঁদেল চোরকেও হার মানায়। পরাজয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। পরাজয়ের জন্যে সিআইএ এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভূমিকাকে দায়ী করেছেন। তিনি যে জনগণের সমর্থন পেতে সমর্থ হননি, সে দুর্বলতার বিষয়টি একবারও উচ্চারণ করেননি। সে কথা ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতাও হিলারির সমালোচনা করে বলেছেন, তিনি যে ভোট করছেন এবং কেনো করছেন, সে বিষয়টি তার নিজের কাছেই স্পষ্ট ছিলো না বলে তিনি যতো উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন, তাতে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প সাম্প্রদায়িক এবং নারী বিদ্বেষী কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। ভোটাররা তাদের জাতীয় স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। মুসলিম বিরোধিতা মানে খ্রিশ্চিয়ানদের আগামী দুনিয়ায় বির্নিঘœ পদচারণের সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেন। সেটাই ছিলো মূল আকর্ষণ। আলো দেখে যেমন শরৎ-হেমন্তের রাতজাগা পোকাগুলো হামলে পড়ে নিজের মৃত্যুকে নিশ্চিত করে, বিএনপিও নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সেই নিশ্চয়তা অর্থাৎ দলের শক্তি ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকে জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন। এখন সহজে সত্যকে না মানতে পারলে তাদের রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া প্রত্যাশিত। মুসলিম লিগও এ ভাবে নিজেদের নির্মূল হওয়ার পথ সুগম করেছিলো। আর তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়া নিশ্চিত করেছিলো ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ভোট-লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে। বিএনপির সামনেও সে পথই এখন খোলা। সেখানে তৃতীয় কোনো রাজনীতিক শক্তির উত্থানও কষ্টকল্পনা নয়। কারণ যারা গণরায়কে মিথ্যে প্রতিপন্ন করতে চায়, তাদের পক্ষে জনগণ থাকে না। জনগণও সেটা বোঝে। তারা নিজেদের ভালোলাগা বোধ এবং যার কাছে গেলে তাদের জীবন ও জীবিকা নিরাপদ থাকবে, তারা সে দিকেই অবস্থান নেয়। একাত্তরেও তা-ই নিয়েছিলো বাঙালি। ফলে আওয়ামী লীগ ১৬৯-এর মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সুতরাং জনগণকে কখনোই বোকা ভাবা এবং তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। করলে জনগণও অবজ্ঞাকারীর বিপরীতে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান নেয়। এটাই এ যাবৎকালের ইতিহাস।
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী রাজনীতিটাকে সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে গ্রহণ করলে তিনি জনগণের আকাক্সক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেবেন না। অন্ততঃ তিনি নির্বাচনে যে সব প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন, তা বাস্তবায়নে ভূমিকা নেবেন বলে নারায়ণগঞ্জবাসীরা কেবল নয়, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান করছেন, তারা সে প্রত্যাশা করেন। একটা জবাবদিহিতার ক্ষেত্রও তিনি সৃষ্টি করবেন। কেনো পারছেন না প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যাও জনগণের কাছে দেবেন। এতে লজ্জা নেই। সব কাজে এবং সব প্রতিশ্রুতি একজন প্রার্থী সমর্থ হবেন এমন প্রত্যাশাও যথার্থ নয়। আইভী পুনর্বার নির্বাচিত হয়ে পিতার ঐতিহাসিক গৌরব যেমন অক্ষুণœ রেখেছেন, তেমনি শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে রাজনীতিক অঙ্গনে তাঁর নিজের অবস্থানকেও দৃঢ়বদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। তিনি আমৃত্যু এইভাবে লড়াই-সংগ্রাম করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে আলোকময় করে রাখবেন, দেশবাসী এমনটাই আশা করে। আমরা তাঁর সাফল্য ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি। তিনি দীর্ঘজীবী হোন। হৃদয়ে বাংলাদেশকে, দেশ অর্জনের ইতিহাসকে ধারণ করতে সমর্থ হোন, থাকুন জনগণের পাশে, যে জনগণ তাঁকে ভালোবাসে, ভোট দেন, তাঁর পরিপার্শ্বজুড়ে অবস্থান নেয়, তাদের প্রিয়জন হয়ে তিনি থাকুন, সবাই এই কামনা করে।