রাবি প্রতিবেদক:‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার বুকে গুলি লাগবে।’ ১৯৬৯ সালের আজকের এই দিনে ছাত্রদের বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এভাবেই চিৎকার করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তৎকালীন প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। সত্যিই সেদিন ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে ড. জোহার বুকে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা।
ড. জোহা রক্ত ঝরার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। পতন ঘটেছিলো সামারিক জান্তা আইয়ুব খানের। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভীত ও রচিত হয়েছিলো ড. জোহার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিলো বাঙালির। ফলে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ড. জোহাকে।
সেই আজন্ম দ্রোহী জোহার শাহাদতের দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দিবসটি শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয় ‘ড. জোহা দিবস’ হিসেবে। এদিন ক্যাম্পাসে ‘শিক্ষক দিবস’ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন।
সেদিন যা ঘটেছিল: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলে গুলি করতে উদ্যত হয়। খবর পেয়ে তৎকালীন রাবি প্রক্টর শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ান। এসময় তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলি করতে নিষেধ করে বলেন, ‘কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে।’ এক পর্যায়ে ড. জোহা ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার দিকে
ক্যাপ্টেন হাদী পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে রাজশাহী মিউনিসিপাল অফিসে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
ড. জোহার সংক্ষিপ্ত জীবনী: ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৪৮ সালে বাকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১ম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে ক্রিশ্চান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে অর্ডিন্যান্স কারখানায় শিক্ষানবিশ সহকারী কারখানা পরিচালক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। পরে লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ড. জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগ দেন। শহিদ হওয়ার সময় তিনি স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। দীর্ঘদিন ধরে তারা আমেরিকায় বসবাস করছেন। এখন সেখানকার নাগরিক হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন বলে জানা গেয়ে।
জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন স্থাপনা: ড. জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার টাকা মূল্যের ডাকটিকেট চালু করা হয়। রাবি ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তার নামে। শহিদ শামসুজ্জোহা হলের সামনে রয়েছে স্মৃতি ভাস্কর্য স্ফূলিঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসানিক ভবনের সামনে চোখে পড়বে জোহার সমাধি। সেখানেই নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ কাজ।