ড.তসিকুল ইসলাম রাজা : বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল এক সত্তা

আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০১৭, ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এসএস তিতুমীর



শিল্প বিভা আর সৃষ্টিশৈলীর সম্মিলনে নিরন্তর যে পথ মানুষকে অসীম আলোকে আগলে রাখে, সে পথই মূলত অনন্ত অক্ষয় চিরভাস্বর ঠিকানা করে দেয় হৃদয় হতে হৃদয়ে। ফুলের সাথে তুলনা করা হয় ব্যক্তিত্বের। ফুল যেমন সৌরভ ছড়ায় ব্যক্তিত্বও তেমনি। পার্থক্য এই যে ফুল ক্ষণিকের তরে আর ব্যক্তিত্ব অনন্তকাল। সবাই যখন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে শীর্ষ ব্যক্তিত্বের আসন প্রপ্তিতে মরিয়া তখনও এমন কিছু ব্যক্তি থাকে যারা সত্য-ন্যায়-নিষ্ঠ পথে থেকে আপন কর্ম চালিয়ে যেতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন না। থোড়ায় কেয়ার করেন শীর্ষত্বের। কিন্তু যার কালাবহ নিমগ্ন সৃজনি আকরে, যিনি আনতশিরে আলিঙ্গন করেন বাস্তবকে, জীবন খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনেন জীবনের নির্যাস, যিনি ইতিহাসের জাতিস্বরই সত্তা হয়ে তুলে আনেন ইতিহাসকে, তিনি  সবার অজান্তেই জায়গা করে নেন সবার হৃদয়ে। তে¤িœ এক ব্যক্তিত্ব, রাজশাহীর গর্ব শিক্ষাবিদ গবেষক সংগঠক সার্থক বাচিকশিল্পি কবি প্রাবন্ধিক এমন বহুধা গুণে গুনান্বিত ব্যক্তিত্ব ড. তসিকুল ইসলাম রাজা। ১৯৫৩ সালের ১১ জানুয়ারি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার  বালিয়াঘাটা গ্রাম, ডাকঘর চৌহদ্দি টোলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সামাজ জীবন ব্যক্তি জীবন রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনি শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা, পেয়েছেন অতীশ দীপঙ্কর ন্বর্ণপদক। ২০০১ সালে  পেয়েছেন জাতীয় শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষকের স্বীকৃতি পদক। ১৯৯৫ সালে লাভ করেন কবি বন্দে আলী মিয়া পদক, ২০০৫ সালে পেয়েছেন রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পদক, ২০০৯ সালে মিতালী সাহিত্য সংসদ (সাতক্ষীরা) কর্তৃক স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও পেয়েছেন ‘কবিকুঞ্জ’ সম্মাননাসহ বহু সম্মাননা।
শিক্ষাবিদ গবেষক সাহিত্যিক এই মানুষটির কর্মচাঞ্চল্য এখনো আমাদের উদীপ্ত করে, উজ্জীবীত করে। রাজশাহীর শিল্প সংস্কৃতি প্রকাশনা এবং শিক্ষা, এসবের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জুড়ে আছে এই মহান শিক্ষাবিদের নাম। তিনি শ্রদ্ধাভাজন, তিনি পরম সম্মানীয়, তিনি শিক্ষাগুরু। তাঁকে নিয়ে  কিছু লেখা ক্ষুদ্র এ কলম ধারকের কাছে ধৃষ্টতার সামিল। তারপরও জন্মদিন উপলক্ষে শুভেচ্ছার দুটো কথা লেখার সুযোগ আর বহুদিন ধরে মনে মনে পুষে রাখা এ লোভা আর সংবরণ করতে পারলাম না। আমার ধৃষ্টতা আর অক্ষমতার জন্য প্রারম্ভেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গোদাগাড়ীর সন্তান হিসেবে তিনি যেমন আমাদের গর্ব পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি আমাদের অহংকার। সাহিত্য চর্চা, গবেষণা, লেখালেখি, সংগঠন করা এসবে তাঁর জুড়ি নেই। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ।  ১৯৭০ সালে কাশিমপুর এ কে ফজলুল হক হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক,১৯৭২ সালে নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। এবং ১৯৭৬ সালে  ¯œাতক সম্মান ডিগ্রি, ১৯৭৭ সালে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এ ডিগ্রি অর্জন করেই তিনি থেমে থাকেননি। জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহার আলোড়ন নিয়ত আন্দোলিত করেছে। তাই তিনি উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য পশ্চিবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিলো ‘ যুদ্ধোত্তর বাংলা কাব্যে পল্লী প্রীতি (১৯১৮-১৯৪৭)’, ১৯৯৪ সালে তিনি  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তখন রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজে কর্মরত। পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে থেকে সাফল্যের সাথে তিনি তাঁর দায়িত্ব পারন করেন এবং পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। একাধারে তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা, ইতিহাস, সম্পাদনাসহ সাহিত্যের প্রায় সকল ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ করেছেন। তাঁর দীর্ঘযাত্রায় মূল্যবান প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কবিতাগ্রন্থ- বাসর ফেলে যুদ্ধে আয় (১৯৮৮), নেই রক্ষা নেই (১৯৮৯)। জীবনী মূলক গ্রন্থ- ছোটদের কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯৮৭)। প্রবন্ধ গবেষণা- শিশু সাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া (১৯৮৩),কতিপয় স্মরণীয় মানুষের জীবন কথা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ(১৯৯১), রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে গ্রামীণ জীবন (১৯৯৪), বরেন্দ্র অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন (১৯৯৯), বাংলাদেশ ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৪), রবীন্দ্রনাথের লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতি ভাবনা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০০৬)। ইতিহাসগ্রন্থ- ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস ’ (যৌথভাবে ১৯৯৯)।
এছাড়া তিনি যে সেব গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন সে গুলো হলো-কবি বন্দে আলী মিয়া স্মারকগ্রন্থ (যুগ্ম,১৯৮৩)), শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ : রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার ( যৌথ,১৯৮৪), সমাজ সেবক আবুল কালাম চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (যুগ্ম ,১৯৮৬), রাজাশাহীতে ভাষা আন্দোলোন (১৯৯০), আবদুল হক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (যুগ্ম,১৯৯৬), রাজশাহী প্রতিভা(১ম খন্ড,যুগ্ম ২০০০),শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি:অভিমত (যুগ্ম ২০০০), নিঃসঙ্গ নদীর মতো:মুহম্মদ মজির উদ্দীন মিয়া স্মারকগ্রন্থ (যুগ্ম,২০০১), সুবর্ণরেখার আলপনা: আবুল হাসান চৌধুরী সংবর্ধনাগ্রন্থ (যুগ্ম,২০০৩), শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি: রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (২০০৭),  রাজশাহীর ইতিহাস (২০০৭), রাজশাহী পরিচিতি (২০০৭), নবাবগঞ্জ পরিচিতি (২০০৭), নওগাঁ মহকুমার ইতিহাস (২০০৭), বগুড়ার ইতিকাহিনী (২০০৭), পাবনার ইতিহাস, যশোহর খুলনার ইতিহাস , সিকদার বাড়ির  ইতিকথা (২০০৭), বাংলাদেশ এবং বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি ( যৌথ,২০১৩), এবং বরেন্দ্রের বাতিঘর অগ্রগতির ৫ বছর  (যৌথ,২০১৩)।
তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠেন আর বড় হয়েছেন আপন মেধা ও চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করে। মানুষকে নিজ কর্মগুণে মুগ্ধ করবার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর মধ্যে। অল্প সময়ে মানুষককে আপন করে নিতে পারেন তিনি। মেধাবী পিতার মেধাবী দু’সন্তান, তারাও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কর্ম জীবনে পদার্পণ করেছে (প্রবাসী)। ভূসম্পত্তি অথবা অর্থবিত্ত তারা না পেলেও বাবাকে পেয়েছেন দেশের শিল্প-সাহিত্যের অনন্য সম্পদ হিসেবে, পেয়েছেন একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে। তিনি তাঁর এ ছোট্ট পরিবার নিয়ে কলোনীর সরকারি বাসাবাড়িতে থাকতেন, নব্বই দশেকের মাঝামাঝিতে সেই বাড়িতেই শিক্ষাগুরুর সাথে প্রথম দেখা হয়। তারপর উঠেন নিজস্ব বাড়ি ‘এরামন ভিলা’য়। সেখানে একটি কক্ষ বইয়ে ঠাসা। সাজানো বইয়ের মাঝখানে বসবার আসন  সেখানে বসলে মনে হয় বইয়ের সমুদ্রে সত্যি! আমরা ভাসমান খড়কুটো মাত্র। অথচ আপ্যায়নের ফাঁকে ফাঁকে স্যারের বলে যাওয়া কথাগুলো একটু একটু করে এই খড়কুটোকে জানার ভারে ভারি করছিলো অমৃতের ব্যঞ্জনায়। সময় চলে যায়, কথা কিছু থেকেই যায়। আর এই থেকে যাওয়া কথাগুলোই বোধকরি কেনো কোনো মানুষের কাছে বার বার নিযে যায়। আর সেখানেই স্যারে উদারতা,সদা দ্বার খোলা। সময় নিয়েই কথা বলেন, দেন পরামর্শ। জানান নানান অজানা কথা। এমন বিদগ্ধ, ধীমান, প্রতিভাধর, জ্ঞানী মানুষের সহচর্য সত্যি চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে। তিনি নিজে যেমন জ্ঞান অন্বেষণ করে চলেছেন, তেমনি তৈরি করেছেন অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। যারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছে,করছে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে।
ইতিহাস -ঐতিহ্যের অবহেলা তাঁকে বেশ পীড়া দেয়। তিনি চান ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের অমূল্য প্রতœ ভা-ার  রক্ষা তরতে। আর যা এখনো রয়ে গেছে সবার অজানা সেসব ঘটনার বর্ণনা তুলে আনতে। এখনো অনেক অঞ্চলের নামের ইতিহাস অনেকেরই অজানা। বিশেষ করে গোদাগাড়ী জনপদের যে সব নাম রয়েছে সে সব নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করা। প্রত্যাশা যেমন আছে ,প্রাপ্তিও তে¤িœ আছে আর ঠিক অপ্রাপ্তি বলবো না বলবো অতৃপ্তা যা সন্ধিৎসুতা বাড়ায় তে¤িœ সন্ধিৎসুতার সাগরে তিনি শেখান সন্তরণের পাঠ। চেতনায় ঢেলে দেন দেশপ্রেম আর  ঐতিহ্য রক্ষার অমর তরল। তিনি যে কেবল প্রকাশনা আর সাহিত্য সেবা নিয়ে কর্মব্যস্ত জীবন পার করছেন তা নয়। এসবের পাশাপাশি বহু সমাজসেবামূলক কাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালান পর্ষদের দায়িত্বসহ শিক্ষাবিভাগের নানান ক্ষেত্রে তিনি দায়িত্ব পালন করে থাকেন। প্রথিতযষা, প্রতিভাময়, জ্ঞানতাপস গুণিজনের ছড়ানো আলো নিঃসন্দেহে আমাদের আমাদের আলোকিত করে। আলোকিত করবে অজীবন। দীর্ঘজীবন কামনায় জানাচ্ছি জন্মদিনের অভিনন্দন আর শুভোচ্ছা, শুভজন্মদিন।