সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১০ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তার স্ত্রী হোসনে আরা। বিচারের ক্ষেত্রে আশার আলোও দেখছেন তিনি। তবে হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী রাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম আইনের আওতায় না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি। গতকাল সোমবার বিকেলে বাড়িতে গেলে এই প্রতিবেদককে তার আশা-হতাশার কথা জানান হোসনে আরা।
জেএমবি সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদ অধ্যাপক রেজাউল হত্যাকা-ের পর থেকেই পলাতক। পুলিশ বলছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাকে আইনের আওতায় আনতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাকে ধরতে দুই লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরও তার সন্ধান মেলেনি।
নিহত রাবি শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা বলছিলেন, তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারায়। শরিফুল ইসলামের বাড়িও একই উপজেলায়। তাছাড়া শরিফুল যে বিভাগে পড়াশোনা করতেন, অধ্যাপক রেজাউল ছিলেন ওই বিভাগের শিক্ষক। এ জন্য রেজাউল করিমের সঙ্গে শরিফুলের সম্পর্কও ভালো ছিল।
হোসনে আরার ভাষায়, ক্যাম্পাসে অধ্যাপক রেজাউল ছিলেন শরিফুলের ‘স্থানীয় অভিভাবক’। তবে শরিফুল কখনও বাসায় যায়নি। এই শরিফুলই জেএমবিতে যোগ দেয়ার পর সংস্কৃতিমনা শিক্ষক রেজাউলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তার পরিকল্পনা মতেই হত্যাকা-টি ঘটে।
অধ্যাপক রেজাউল করিমকে গত ২৩ এপ্রিল ভোরে নগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাসা থেকে মাত্র ১০০ গজ অদূরে একটি গলির ভেতর কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর থানায় মামলা হলে বিভিন্ন সময় ১২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের মধ্যে থেকে রাবির এক শিক্ষার্থী কারাবন্দী অবস্থায় মারা যায়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রেজাউস সাদিক জানান, হত্যার ছয় মাসেরও বেশি সময় পর রোববার (৬ নভেম্বর) দুপুরে আদালতে মোট আটজনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এদের মধ্যে বগুড়ার শিবগঞ্জের মাসকাওয়াত হাসান সাকিব ওরফে আবদুল্লাহ, রাজশাহীর খড়খড়ি এলাকার আবদুস সাত্তার ও তার ছেলে রিপন আলী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী রহমত উল্লাহ কারাগারে আছেন। তারা হত্যায় জড়িত থাকার ব্যাপারে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বাগমারার শরিফুল পলাতক। অপর তিন জঙ্গি বগুড়ার খাইরুল ইসলাম বাধন, পঞ্চগড়ের নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক হাসান ও জয়পুরহাটের ওসমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন।
পরিদর্শক রেজাউস সাদিক বলেন, ‘আটজনের নামে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও তিনজন মারা গেছে। তাই বিচার হবে পাঁচজনের। এরা সবাই জেএমবির সদস্য। হত্যাকা-টিও ঘটিয়েছিল জেএমবি। তবে এ মামলায় বর্তমানে ১১ জন কারাগারে আছেন। যদিও এদের মধ্যে থেকে অভিযোগ আনা হয়েছে চারজনের নামে। তদন্তে হত্যাকা-ের সঙ্গে বাকি ৭ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তারা এখন আইনি প্রক্রিয়ায় কারাগার থেকে বের হবেন। হত্যার অভিযোগ থেকে অভিযোগপত্রেই তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে নিহত শিক্ষকের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘আমি চাই কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন অভিযুক্ত না হয়। পুলিশের ওপর আমার আস্থা আছে। কারাবন্দী যে ৭ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, তারা নিশ্চয় হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে আমার একটিই দাবি, শরিফুলকে আইনের আওতায় আনা হোক। কারণ, তার পরিকল্পনাতেই হত্যাকা-টি ঘটে। শরিফুল এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় আমরা হতাশ। তবে এটুকু স্বস্তিও পাচ্ছি-অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার মধ্যে দিয়ে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো। এখন চাই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হত্যা মামলাটির বিচার কাজ দ্রুত শেষ করা হোক।’
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে হোসনে আরা বলেছেন, মামলার তিন আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ায় তিনি খুশি হতে পারেননি। তাদের গ্রেফতার করে জনসম্মুখে হাজির করা হলে তিনি বেশি খুশি হতেন। তাহলে জাতি তাদের কর্মকা- সম্পর্কে জানতে পারত। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শরিফুল যেন কোনোভাবেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা না পড়েন, এও চান তিনি।
সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার রাজশাহীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অধ্যাপক রেজাউল হত্যার পরদিনই শরিফুল ভারতে পালিয়ে গেছেন। ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে জঙ্গি আবু সুলেমানকে খুঁজছে, তিনিই রাবি শিক্ষক হত্যার আসামি শরিফুল। এই সুলেমান (শরিফুল) গত ৬ জুলাই ভারতের বর্ধমান রেলস্টেশন থেকে গ্রেফতার হওয়া আইএস জঙ্গি মসিউদ্দীন ওরফে মুসার ‘গুরু’। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল কলকাতায় গিয়ে ওই মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ছবি দেখিয়ে নিশ্চিত হয়, সুলেমানই রাবি শিক্ষক হত্যার আসামি শরিফুল। তার বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। বাবার নাম আবদুল হাকিম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম বলেন, এ রকম কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। বিষয়টি সম্পর্কে তারা নিশ্চিতও নন। তাকে ধরতে আরএমপির পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে সব ধরনের চেষ্টায় তারা করছেন।