ড. শামসুজ্জোহার শাহাদাতবার্ষিকী আজ, ৫৫ বছরেও মেলে নি জাতীয় স্বীকৃতি

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪, ১১:৪৮ অপরাহ্ণ


রাবি প্রতিবেদক:১৯৬৯ সালের ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সরকারের সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। প্রথমদিনের হামলায় রক্তে রঞ্জিত হয় কয়েক শিক্ষার্থী। সেদিন সন্ধ্যায় বিশ^বিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে এক প্রতিবাদ সভায় ছাত্রদের রক্ত লাগা নিজের শার্ট দেখিয়ে এক শিক্ষক বলেছিলেন- ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর কোনো গুলো হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে’। ওই শিক্ষক হলেন রাবির তৎকালীন প্রক্টর ও গণঅভ্যুত্থানে নিহত প্রথম শহিদ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। যিনি ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে নিজের বুক পেতেছিলেন হানাদার বাহিনীর বন্দুকের সামনে।

ড. শামসুজ্জোহার যা ঘটেছিল ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি:
এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী মুহম্মদ আবদুল খালেক। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি ‘শহীদ ড. শামসুজ্জোহা ও আমি’ এবং ‘শহীদ ড. শামসুজ্জোহা’ নামে দুটি বইও রচনা করেছেন। বই দুটিতে ওইদিনের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উত্তাল হয়ে ওঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বের হলে উপাচার্যের সঙ্গে জরুরি বৈঠক ফেলে ছুটে যান ড. জোহা। ছাত্রদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনেন।

তাতেই বিপত্তি ঘটে। প্রশাসন মনে করে, যে ব্যক্তি এক ডাকে ফেরাতে পাওে সেই হয়তো ছাত্রদের রাস্তায় নামিয়েছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সেদিন তার কথা কাটাকাটিও হয়। সেই মিছিলে আহত ছাত্রদের তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেইদিনই রাত ১০টায় শহীদ মিনারে (কলাভবনের সামনে) প্রতিবাদ সভায় ড. শামসুজ্জোহা বলেন, ‘শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরবো।’

পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে আবারও রাবি প্রধান ফটকের কাছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ বাঁধে। এসময় সেনারা শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালাতে উদ্যত হলে সে সময়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোহা বলেন, ‘পি¬জ, ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে এখান থেকে।’ অনুরোধ উপেক্ষা করে লেফটেন্যান্ট বলেন, ‘ফায়ার অ্যান্ড কিল দেম’। গুলি চালাতে গেলে ড. শামসুজ্জোহার নিজে এগিয়ে যান। তখন তার ওপরই গুলি চালায় সেনারা।

একইরকম বর্ণনা পাওয়া যায় শহীদ শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দাবানলেও। রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুলের পরিচালনায় চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০১২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এছাড়া, আনিসুর রহমান সম্পাদিত ‘তিমির হননে’ শীর্ষক প্রকাশনায় পাওয়া যায় শিক্ষক ড. জোহাকে হত্যার মর্মান্তিক বর্ণনা।
বিশ^বিদ্যালয় চত্বরে শায়িত ড. শামসুজ্জোহা:

মহান শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার সমাহিত করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের সামনে। যা এখন জোহা চত্বর নামেই পরিচিত। বিশ^বিদ্যালয়ের পপধান ফটক দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে এটি।

ড. জোহার স্মরণে যা রয়েছে:
ড. শামসুজ্জোহার স্মরণীয় করে রাখতে বিশ^বিদ্যালয়ে একটি হলের নামকরণ করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহা হল। পরবর্তীতে সেই হলের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে স্ফুলিঙ্গ ভাস্কর্য। এছাড়াও ড. জোহার শহিদ হওয়ার স্থানে (ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের মাঝখানে) নির্মাণ করা হয়েছে ড. শামসুজ্জোহা স্মৃতিফলক। পাশাপাশি তার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করাসহ তার নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও নাটোরে তার নামে একটি কলেজ রয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক দিবস:
ড. শামসুজ্জোহা নামটি শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাবিতে এই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অথচ গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ হওয়া এই ব্যক্তিটির নাম সারাদেশে পরিচিত হওয়ার কথা ছিল। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও দিবসটি এখনও জাতীয় স্বীকৃতি পায় নি। অনেক আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দিবসটি জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসলেও ড. শামসুজ্জোহার ৫৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতেও জাতীয় স্বীকৃতি মেলে নি এই দিবসের।

বারবরের মত এবারও ড. শামসুজ্জোহার শহিদ হওয়ার দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান শহীদ শামসুজ্জোহা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক একরামুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১৮ ফেব্রুয়ারির দিনটিকে আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক দিবস হিসেবে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। ড. শামসুজ্জোহার স্যার আমাদেও দেশের প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী। তিনি ছাত্রদের জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। আমরা অনেক আগে থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি, এই দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। যাতে ওনার এই আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতি বছর সারাদেশে পালন করা হয়। কিন্তু কেনো স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে নীতি-নির্ধাকরা আশ^াসও দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু কেনো সেটার বাস্তবায়ন হয় না, সে বিষয়ে ওনারাই বলতে পারবেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ