ঢালাও মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ, সামলাতে কী করছে সরকার?

আপডেট: জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ১:৪৭ অপরাহ্ণ


সোনার দেশ ডেস্ক :


বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত জুলাইয়ে রাজধানীর পুরানো ঢাকার যে জায়গায় নাদিমুল হাসান নিহত হন, ঠিক তার অল্প কিছু দূরে তারই সাথে আন্দোলন করছিলেন আরেক শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার।

অথচ তারই বাবাকে আসামি করা হয়েছে ওই হত্যা মামলায়। নাম বাদ দিতে তাদের কাছে টাকা দাবি করা হয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
মিজ আক্তারের ভাষায়, “যে ছেলেটা আমার সামনে মারা যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে, তার মামলায় আমার বাবাকে (আসামি) দিছে।

আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম এটা কীভাবে সম্ভব? এটাতো সম্ভব হতে পারে না। ওইদিন ওর থেকে এক হাত দূরে, যদি ওই গুলিটা ওর গায়ে না লাগতো, আমার গায়ে তো লাগতে পারতো।”

বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে করা মামলাগুলোতে এরই মধ্যে আসামি করে, আসামি করার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি, কিংবা মামলা থেকে নাম খারিজ করে দেয়ার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছে।
পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গেছে, অন্তর্র্বতী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিষয়টি স্বীকার করে কয়েকবারই বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।

সর্বশেষ অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ভুয়া মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে, সরকারের তরফ থেকে এমন বলা হলেও এখন পর্যন্ত শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯শে জুলাই পুরানো ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের শিক্ষার্থী নাদিমুল হাসান এলেম।

এ ঘটনায় ৮৯ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করে তার মা কিসমত আরা।
তবে যাদের আসামি করা হয়েছে মামলার বাদী তাদের চেনেন না।

কিসমত আরা বলেন, “আমিতো চিনি না ওদেরকে। যাদের মাধ্যমে মামলাগুলো করেছি ওনারা এ নামগুলা দিয়েছে। এখন ওনারা ভুলবশত দিয়েছে না কীভাবে দিছে আমি তো এটা বলতে পারি না। এরকম কাগজ নিয়ে আসছে, বলে সিগনেচার করেন। এই ঘর, ওই ঘর, আমি কী কিছু বলতে পারি। তারা বসে পড়ছে, পড়ে আমি কী করতে পারি।”

বাদীর স্বামী জানান, আদালতেই পাশের এক এজলাসে (যাদের মাধ্যমে মামলা করা হয়েছে তাদের কথা বোঝান) বসে মামলা।
যেদিন নাদিম মারা যান ওই সময় ঘটনাস্থলেই আন্দোলনরত অবস্থায় ছিলেন সুলতানা আক্তার। এই হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে সুলতানার বাবাকে।

মিজ আক্তার বলেন, “আন্দোলন করলাম, যেখানে আমার বাবা আমাকে সাপোর্ট দিলো, আমাকে রাত একটা বাজে বাবা আমাকে নিয়ে আসে রাস্তা থেকে, আজকে সেই বাবার জন্য আমি কিছু করতে পারতেছি না। সেই বাবাকেই আসামি বানিয়ে দিছে আজকে এরা।”

রাজনৈতিক কারণে নয় বরং ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে এ হত্যা মামলায় মিজ আক্তারের বাবাকে আসামি করা হয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি।
আসামির তালিকা থেকে বাবার নাম বাদ দেয়ার জন্য তিনি মামলার বাদীর স্বামী শাহ আলমের সাথে যোগাযোগ করেন মিজ আক্তার।

আসামির মেয়ে সুলতানা আক্তার
ছবির ক্যাপশান,নাদিমুল হাসান হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে আরেক আন্দোলনকারী সুলতানা আক্তারের বাবাকে।
বিনিময়ে মি. আলম তিন লাখ টাকা দাবি করেন বলে জানান মিজ আক্তার। একইসাথে নাম বাদ দিতে পুলিশ, কোর্টসহ নানা জায়গায় খরচের কথাও মি. আলম তাকে জানায়।

সুলতানা আক্তার বলেন, “আমি তাকে বললাম আমিও তো ছাত্র আন্দোলনের একজন স্টুডেন্টস। পুলিশেরটা আমার কাছে ছেড়ে দেন। ওসির সাথে না হয় আমি কথা বলে নেব, যদি ওই খানে টাকা লাগে। এছাড়া আপনি কী করতে পারেন। ওনি বললেন আচ্ছা ঠিক আছে তিন লাখ টাকা নিয়ে আইসেন, আমি মামলা উঠায়া দিব।”

যদিও মি. আলম প্রথমে টাকা চাওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
কিন্তু পরে স্বীকার করে বলেন, “ওইটা আমি দুষ্টামি করছি। আমি কইছি যে তিন লাখ টাকা নিয়া আসো আমি ব্যবস্থা কইরা দিমু। তারপর আবার বলছি যে এক টাকাও লাগবে না।”

তিন লাখ টাকা চাওয়ার পর মিজ আক্তার কী বলেছেন জানতে চাইলে মি. আলম জানান, “আমারে ওই মেয়েটা বলছে যে আমার কাছে তো এতো টাকা নাই। এক লাখ টাকা আপনারে বলছিলাম। আমি কইলাম দেখরে বাবা তোমার বাবার নাম কাটা যাওয়ার খরচো আছে এখানে, পুলিশ কি টাকা নিবে না মনে করেন? কোর্ট খরচো নিব না? এটা কি আমি খরচো করুম?”

মি. আলমের বক্তব্যেই এটা স্পষ্ট যে সুলতানা আক্তারের বাবার নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিতে টাকা দাবি করেছেন তিনি।
কোনো রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হলেও তিনটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে জানান এক ব্যক্তি। তবে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি।

তিনি জানান মূলত মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের জন্য তাকে আসামি করা হয়েছে।
বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।

“আমাকে প্রথম বলছে যে মামলায় দিবে না। পরে মামলায় দিছে। জিজ্ঞেস করার পর বলছে নাম কাইটা দিবে। সেজন্য টাকা দেওয়া লাগছে। প্রথম ২০ লাখ টাকা দিতে বলছে, ২০ লাখ টাকা দেয়ার পরে আরও সাত লাখ টাকা দিতে বলছে। পরে আরও সাত লাখ টাকা দেওয়া হইছে। টোটাল ২৭ লাখ টাকা,” বলেন ওই ব্যক্তি।

তার দাবি টাকা দেয়ার পর মামলা থেকে বাদ তো দেয়ইনি বরং তার বিরুদ্ধে আরও বেশি মামলা করা হয়েছে।
“আমাকে এবং আরও অনেককেই, যারা রাজনীতি করে নাই, যাদের কাছে টাকা আছে, তাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে, টাকা আদায় করার জন্য,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি।

দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলাগুলোতে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার জন্য টাকা আদায় করার অভিযোগে একের পর এক ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে।

সরকারের পদক্ষেপ কী ?
এরই মধ্যে অন্তর্র্বতী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এসব মামলাকে ঘিরে যে বাণিজ্য হচ্ছে তা স্বীকার করে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলেছেন।
গত ৩০শে ডিসেম্বর জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে ঢাকা বিভাগে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা জানান।

মি. নজরুল বলেছেন, “নরমাল কোর্টে মামলা নিয়ে আমি শুনেছি অনেক ধরনের অসঙ্গতি হচ্ছে। মামলা নিয়ে ব্যবসা করছে। কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ভুল মামলা দিচ্ছে। প্রকৃত অভিযুক্তদের পাশাপাশি অনেক লোককে আসামি করে মামলাকে হালকা করার চেষ্টা করছে।”

“মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যার অপরাধ। এই হত্যার অপরাধের বিচারের দাবি, বিচারের প্রত্যাশা এটাকে নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে আমাদের সমাজে। এদেরকে আমরা চিহ্নিত করব। অবশ্যই তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে,” বলেন মি. নজরুল।

সঠিকভাবে মামলা করার আহ্বান জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, “প্রথমেই আমাদের শুদ্ধভাবে মামলা করতে হবে। আমাদের আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লিগ্যাল এইড একটা সেল করে দেব।”

“কথা দিচ্ছি সাত দিনের মধ্যে করে দেব। শহীদ পরিবারের মামলার ব্যাপারে তোমরা যদি লিগ্যাল এডভাইস চাও আমরা ওখান থেকে এডভাইসটা করতে পারবো। আমাদের পক্ষ থেকে যা করার আমরা করবো,” বলেন মি. নজরুল।

এর প্রায়, এক মাস আগে সচিবালয়ে মি. নজরুল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “যারা হয়রানিমূলক মামলা করছেন, মিথ্যা মামলা করছেন এবং বাণিজ্যমূলক মামলা করছেন, কাউকে কাউকে নাকি থ্রেটও দেয়া হচ্ছে টাকা না দিলে মামলা করা হবে, আপনারা কিন্তু মনে রাইখেন আমি যদি এই মন্ত্রণালয়ে থাকি, আপনাদের কীভাবে শাস্তি দেয়া যায় সেটার আইনও আমি খুঁজে বাইর করবো।”

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক বলেন, “বাদী যখন বলে আমি চিনি না তাইলে বাদী কার প্ররোচনায় নামটি দিয়েছে সেটি উদঘাটন করতে হবে।”

“আসামিদের টেলিফোন করে যখন টাকা চাওয়া হয় তখন এটা বের করা তো কঠিন কিছু না। এ মামলা বাণিজ্য ইমিডিয়েট বন্ধ করতে হবে। সমন্বিত উপায়ে বন্ধ করতে হবে। দুই-একটা থানাকে মডেল টেস্ট হিসেবে নিয়ে বন্ধ করতে হবে,” বলেন মি. ফারুক।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ