বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায়
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ বলে যতই আত্মতুষ্টি লাভ করুন না কেন, বেকারত্ব যে আমাদের প্রধান সমস্যা, তা আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদেরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ধাধাঁ বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে কর্মসংস্থানের বৈপরীত্য সেই ধাধাঁর অংশ।
এক দশক ধরে বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে এবং গত দুই বছরে ৭ শতাংশে উন্নীত হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবমতে, বাংলাদেশে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৫ লাখ। আইএলওর ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড এশিয়া প্যাসিফিক ও আরব স্টেটস জানাচ্ছে, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ তরুণ নিস্ক্রিয়। তাঁরা পড়াশোনা করছেন না, আবার কাজও করছেন না। জরিপ অনুযায়ী বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
আমাদের দেশে প্রতিবছর ২৩ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও এর উল্লেখযোগ্য অংশ কাজ পায় না। আবার এই কাজ না পাওয়া জনশক্তির বিরাট অংশ শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত। কয়েক বছর আগে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট জানিয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় বিদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করতে হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে অকেজো অসমর্থ্য তা আর নতুন করে বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। এই জনসংখ্যার প্রায় ৩ কোটি বেকার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে বাংলাদেশে বেকার জনসংখ্যার ২৮% ইচ্ছাকৃত বেকার। প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ তরুণ উচ্চশিক্ষা শেষ করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রতিবছর দেশে ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় না। এ জন্য অধিকাংশ বেকার সরকারকে দোষ দেয়, সিস্টেমকে দোষ দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদের এ বেকার থাকার জন্য শুধু সরকার বা সিস্টেমই দায়ী নয়। দায় তাদেরও আছে। তাদের শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে এ বেকার থাকার জন্য অনেকাংশে তারাই দায়ী। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত যুবকের লক্ষ্য সরকারি চাকরি করা। যত দিন পর্যন্ত সরকারি চাকরি না পায় ঠিক তত দিন তারা বেকার থাকে। অথচ বেকার না থাকার কর্মকেন্দ্রীক ডিপ্লোমা শিক্ষার ধারে কাছেও যায় না।
আমাদের শিক্ষিত বেকারদের শুধু সরকারি চাকরির টেনডেন্সি আছে। অথচ ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশের লোকেরা আমাদের দেশের মত উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পর্যন্ত অধ্যায়ন করে না। তারা ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁেজ বের করে। ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করে সরকারি চাকরি না করে বরং নিজে কিছু করা বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় উদ্যোক্তা হয়। চাকরি শব্দটি এসেছে চাকর থেকে। তারা অন্যের অধীনস্থ না হয়ে বরং উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। আর ইতিহাস বলছে পৃথিবীতে যেসব জাতি বড় হয়েছেন, যেসব ব্যক্তিরা ধনকুবের হয়েছে, তারা উদ্যোক্তা ছিলেন। অ্যান্ডু কার্নেগির ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। কিশোর বয়সে বস্তির ছেলে এবং ময়লা কাপড় পরিহিত ছিল বলে তাকে পাবলিক পার্কে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর সে কার্নেগি পৃথিবীর তাবৎ জনগোষ্ঠীর উদ্দ্যোক্তা সৃষ্টির আলোড়নকারি হিসাবে চিরভাম্মর।
সভ্যতার অগ্রযাত্রায় হাজার বছর ধরে চলেছে মানুষ। চলেছে কখনও কঠিন হিম শৈলে, কখনও গভীর অরণ্যে। চলতে চলতে কখনো সামনে পেয়েছে অম্বর স্পর্শী গিরিমালা, কখনোও বা এসে দাঁড়িয়েছে দিগন্তপ্লাবী জলদির সামনে। তবু বিরাম নেই চলার। কোন কিছুই অনতিক্রম্য থাকেনি মানুষের। মাটি থেকে আকাশে, আকাশ থেকে মহাআকাশে। সীমা থেকে অসীমে, অন্ত থেকে অনন্তের দিকে চলেছে মানব অভিযাত্রা, অভিযাত্রার অনুপ্রেরণা। আজকের দিনে শিক্ষার সাথে ডিপ্লোমা শব্দটি গঠনের হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান, জার্মান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পূর্ণগঠনে ডিপ্লোমা শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করেছিল। যেখানে হাইস্কুল আছে তার’ই পার্শ্বে প্রতিষ্ঠা করেছিল ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমান জাপানে ডিপ্লোমা শিক্ষার হার ৫৬ শতাংশ, জার্মানিতে ৬৪ শতাংশ। ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণ করে নিজ এলাকায় শিল্প কারখানা, হাসপাতাল, ক্লিনিক গড়ে তুলে। ঐসব দেশে বেকার কোন শব্দ নেই। আমাদের দেশের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ কখনো অলস বা কর্মবিমুখ নয়। পরিবারের একটু স্বাধীনতার জন্য। একটু সুখের জন্য বাবা-মা, ভাই-বোন ছেলে মেয়ে এমনকি প্রিয়তমা স্ত্রী ছেড়ে বিদেশ বিভূঁই দিন কাটায়।
ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজ দেশ ছেড়ে লাখ লাখ মানুষ আজ ভিন দেশে রাস্তায় বাঁচার জন্য হাঁটছে। কখনো বা নৌকা, কখনো বা ভেলায় চড়ে জীবন বাজি রেখে লাখো লাখো মানুষ আজ সাগরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। ভিন দেশে প্রবেশের জন্য এসব মানুষেরা কখনো পাড়ি দিচ্ছে সাগরের উত্তাল জলরাশি, কখনো পাড়ি দিচ্ছে পাহাড়ি জঙ্গলের কন্টকাকীর্ণ পথ আবার কখনো পাড়ি দিচ্ছে সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া। ওরা রোদের গরমের পুড়ছে, বৃষ্টির পানিতে ভিজছে আর রাত্রে খোলা আকাশের নীচে ঘুমাচ্ছে। ভয়ংকর এবং বিপদসংকুল এই যাত্রাপথে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ। বাঁচার তাগিদে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে শত শত বাংলাদেশি। ভূমধ্যসাগরের পাচঁ হাজার কিলোমিটার এখন গণকবরে পরিণত হয়েছে।
সময় এসেছে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিকল্প কিছু ভাববার। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বেকারত্ব দূর করে তারুণ্যের কর্মসংস্থান প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে শিক্ষাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জন্য চাই ডিপ্লোমা শিক্ষায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। জনশক্তি রপ্তানির হিসাবে বৈদেশিক চাহিদা মোতাবেক পেশা ও পণ্যভিত্তিক ডিপ্লোমা শিক্ষা কোর্সের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্গম এলাকা বিশেষ করে হাওর, দ্বীপ, উপকূল, বরেন্দ্র, পাহাড়, সীমান্তবর্তী এলাকায় তরুণরা এসএসসি পাশ করার পর ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে পারে এমন ব্যবস্থা তৃণমূলে করতে হবে।
সুযোগ আর মানসিক শক্তির সমন্নয় সাধনই তারুণ্যের কর্মসংস্থান। আমাদের বিশাল বেকার তরুণ যুবগোষ্ঠীকে সেই সুযোগ দিতে হবে। তরুণদের কর্মের যোগফলই আগামীর সমৃদ্ধ উন্নত কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ। (লেখকদ্বয় : ডিপে¬ামা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিলের সভাপতি ও মহাসচিব।)