তারাবীহ নামাজের ফজীলত

আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৩, ৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ড. মাওলানা ইমতিয়াজ আহমদ:


রমজানুল মুবারক এবাদতের বসন্তকাল। দিনে রোজা এবং রাতে ‘কিয়ামে রমজান’ অর্থাৎ তারাবীহ এ মুবারক মাসের মৌলিক আমল। আল্লাহ তায়ালা কুরআন কারীমে নির্দেশ জারি করে রমজানের দিনে রোজা ফরজ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলায় কিয়াম সুন্নাত করে দিয়েছেন। কিয়াম বলতে এখানে তারাবীহ বুঝানো হয়েছে। বিভিন্ন হেকমতের কারণে তারাবীহ নামাজকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাই রাখা হয়েছে, ফরজ করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখবে তার পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রাতের নামাজ অর্থাৎ তারাবীহ পড়বে তারও পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারী ও মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কখনো তারাবীর নামাজ জামায়াতে পড়িয়েছেন। আবার কখনো এমন হয়েছে যে, কয়েক রাকায়াত জামায়াতের সাথে পড়ে হুজরায় চলে গেছেন এবং একাকী নামাজে রত থেকেছেন। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত তারাবীহ’র জামায়াত পড়াননি। বরং অধিকাংশ সময় একাকীই পড়তেন। জামায়াতের সাথে নিয়মিত নামাজ পড়লে এ নামাজটিও উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যেতে পারে এ আশংকায় তিনি নিয়মিত জামায়াতের নিয়ম করেননি। রমজানের কোনো এক রাতে উমর রা. তাঁর খেলাফতকালে মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান এবং সেখানে দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামায়াত হচ্ছে, তিনি চিন্তা করলেন সকল নামাজীকে এক ইমামের পেছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। তখন তিনি এই আদেশ জারী করেন এবং উবাই ইবনে কা’ব রা.কে ইমাম বানিয়ে দেন। (বুখারী)
এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. (মৃ. ৪৬৩ হি.) মুয়াত্তা মালেকের অতুলনীয় ব্যাখ্যাগ্রন্থ আততামহীদ-এ বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এখানে নতুন কোনো কিছু করেননি। তিনি তা-ই করেছেন যা খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করতেন। কিন্তু শুধু এই আশংকায় যে, নিয়মিত জামায়াতের কারণে তারাবীহর নামাজ উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যায় কিনা, নিজে জামায়াতের ব্যবস্থা করেননি। উমর রা. এই বিষয়টি জানতেন। তিনি দেখলেন, নবীজীর ইন্তেকালের পর এখন আর এই ভয় নেই। তখন তিনি নবী-পছন্দের অনুসরণ করে ১৪ হিজরীতে জামায়াতের ব্যবস্থা করে দেন।

ইমাম বুখারী রাহ.-এর উস্তাদ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা রাহ. (১৫৯-২৩৫হি.) তার মূল্যবান হাদীস সংকলন আলমুসান্নাফ-এ প্রসিদ্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে বিশ রাকায়াত তারাবীহ ও বিতর পড়তেন।

মসজিদে নববীতে ১৪ হিজরী থেকেই হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর ইমামতিতে প্রকাশ্যে বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়া হতো। মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণই সেই মুবারক জামায়াতের মুসল্লী ও মুক্তাদী ছিলেন। শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম- যাদের থেকে অন্যান্য সাহাবী দীন শিখতেন, যারা কুরআনের শিক্ষা, হাদীস বর্ণনা ও ফিক্হ-ফতওয়ার স্তম্ভ ছিলেন তাদের অধিকাংশই তখন মদীনায় ছিলেন। তারা সবাই বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়েছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর ভাষায়, এটা প্রমাণিত যে, উবাই ইবনে কা’ব রা. রমজানের তারাবীহতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকায়াত পড়তেন এবং তিন রাকায়াত বিতর পড়তেন। তাই অনেক আলেম এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এটিই সুন্নাত। কেননা, উবাই ইবনে কা’ব রা. মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই বিশ রাকায়াত পড়িয়েছেন এবং কোনো একজনও তাতে আপত্তি করেননি। (মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১১৩)

তারাবীহর নামাজের মাসায়েল

  •  যদি কেউ মসজিদে এসে দেখেন এশার জামায়াত হয়ে গেছে এবং তারাবীহ শুরু হয়ে গেছে তখন তিনি একা একা এশা পড়ে নিয়ে তারপর তারাবীহর জামায়াতে শরীক হবেন। ইতোমধ্যে যে কয় রাকায়াত তারাবীহ ছুটে গেছে তা তিনি তারাবীহ ও বেতর জামায়াতের সাথে আদায় করার পর পড়বেন।
  • রমজান মাসে তারাবীহর মধ্যে তরতীব অনুযায়ী একবার কুরআন শরীফ খতম করা (পড়া বা শোনা) সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।
  • কোনো কারণে তারাবীহর জামায়াতে শরীক হতে না পারলে একাকী তারাবীহ পড়ে নিতে হবে।
  • ২৭শে রাতে তারাবীহ খতম হওয়ার পর বাকী দিনগুলোতে অনেকে তারাবীহ পড়েন না। এটা খুবই অন্যায়। অথচ সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
  • নারীদের জন্য মসজিদে নয় বরং ঘরের নিভৃতে একাকী নামাজ পড়া উত্তম। সেখানেই তাদের সওয়াব বেশি। হানাফী মাজহাবে নারীদের জন্য মসজিদে তারাবীহর জামায়াতে শরীক হওয়া মাকরূহ।
  • নারীগণ তারাবীহর নামাজ একাকী পড়বেন।

তারাবীহ নামাজসহ অন্যান্য এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নৈকট্য অর্জনের তাওফীক দান করুন।
লেখক: পেশ ইমাম, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট জামে মসজিদ, রাজশাহী