মাহাবুল ইসলাম:
আপনি, আমি ও আমরা কী খাচ্ছি? যেটা খাচ্ছি, সেখানে খারাপ কোন উপাদান মিশ্রিত নেই তো? খাবার নিরাপদ কী না?-ভেজালের চরম দৌরাত্ম্যের যুগে স্বাস্থ্য সচেতন প্রত্যেকটি মানুষের মনে এমন শত প্রশ্ন জন্ম নেওয়াটা এখন স্বাভাবিক বিষয়। এই দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেতে নানা কৌশলও অবলস্বন করে থাকেন ক্রেতারা। কিন্তু দিনশেষে অহরহই ঘটছে প্রতারণার ঘটনা। তবে এবার বিনামূল্যেই খাবারের সেই ক্ষতিকর উপাদান শনাক্ত করা যাবে খুব সহজেই। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমান ল্যাব ন্যূনতম ৩ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৫০ ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খাবারের ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি আপনাকে জানিয়ে দিবে! এরইমধ্যে যার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন রাজশাহী বিভাগের স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ অক্টোবর থেকে রাজশাহী বিভাগে একটি মোবাইল ল্যাবরেটরি কাজ করছে। এই ল্যাবরেটরিতে মোট ৩৭ টি পরিক্ষার মধ্যে ২৩ টি পরিক্ষা বিনামূল্যেই করানো হচেছ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিসাররাও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করছেন। যা খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পথকে শুধু মসৃণই করছে না নতুন দিগন্তও উন্মোচন করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে তারা সাধারণ মানুষকেও এসব পরীক্ষাগুলো করানোর বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, দুধে ক্ষতিকর উপাদান শনাক্তের ৫ টি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৫ থেকে ১০ মিনিটে ও একটিতে ৫০ ঘণ্টায়, ঘি, বাটার, চিজ, কনডেন্স মিল্ক, মিল্ক পাউডারের ৩ টি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৮ থেকে ১৫ মিনিট, হলুদ গুড়ার ৪ টি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৪ থেকে ১২ মিনিট, মরিচ গুড়ার ২ টি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৮ থেকে ১২ মিনিটে, গোলমরিচের একটি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৫ মিনিটে, নারকেল ও ভোজ্য তেলের একটি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৬ মিনিটে, চাল-ডাল-মিষ্টান্ন-আইসক্রিমের দুইটি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৮ থেকে ১০ মিনিটে, সবজির একটি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৩ মিনিটে, রুটির একটি পরিক্ষা এবং ফলাফল ৬ মিনিটে, এটিপি কুইক সুইব টেস্টের ফলাফল ৫ মিনিটেÑ এছাড়া অন্যান্য গুড়া মসলার পরিক্ষা ও ফলাফল ৩ মিনিটেই সরবরাহ করা হচ্ছে এই ভ্রাম্যমান ল্যাবে।
সম্প্রতি রাজশাহীর হোটেল-রেস্তোরাঁয় পোড়া তেলের আধিক্য থাকার বিষয়টি আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর শাখা জেলার গোদাগাড়ী ও পুঠিয়া উপজেলার ১৬টি হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং রাজশাহী মহানগরের ২২ রেস্তোরাঁর তেল পরীক্ষা করেন। সেখানে ৮৭ ভাগ তেলে ক্ষতিকর পোলার ম্যাটেরিয়ালের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এরমধ্যে ৫৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ ক্ষতিকর। আর ২৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ তেল ব্যবহারের অনুপযোগী। এ রিপোর্ট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের সচেতন হতে আরও উদ্বুদ্ধ করছে।
রাজশাহী কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সেহের আলী বলেন, একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে স্বাস্থ্য বিষয়েও সচেতন হতে হয়। আসলে চারিদিকে এতো ভেজালের দৌরাত্ম্য তা সহজেই অনুমেয়। যেগুলো খালি চোখে দেখা যায়, তা তো বর্জন করি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন হয় যে, মনে সন্দেহ পোষণ করি, কিন্তু বুঝতে পারি না। আর প্রয়োজনের তাগিদেই খেতে হয়। তবে পোড়া তেলের আধিক্যের বিষয়টি যখন বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা-নিরিক্ষার আলোকে উঠে আসলো, তখন এ বিষয়ে আরও সতর্ক হয়েছি।
ক্রীড়া লেখক সমিতির রাজশাহী শাখার সিনিয়র সদস্য এম হক নিশান বলেন, আমরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বাস্থ্য বিষয়ে বাড়তি সতর্কতার সঙ্গেই যতœ নিয়ে থাকি। খাবারের মধ্যে অনেক কিছুই এড়িয়ে যায়। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখেই সন্দেহ হয়। কিন্তু প্রমাণ করার একটি বিষয় থাকে। সেখানে আর যাইহোক নিত্যই যে পণ্যটা খাচ্ছি, তা নিয়ে যদি কোন সন্দেহ হয়, তাহলে বিনামূল্যেই সেটা পরিক্ষা করে নেওয়ার যে ব্যবস্থা সেটা সত্যিই অনেক ভালো উদ্যোগ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. পার্থ মনি ভট্টাচার্য বলেন, শুধু পোড়া তেল নয়; যে কোন খাবারেই ভেজাল বা অস্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না ও পরিবেশন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্য নিরাপদ না হলে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। লিভার, কিডনির সংক্রমণসহ ক্যান্সারও হতে পারে। মানবদেহের জন্য নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করা অপরিহার্য একটি বিষয়। এটির ব্যত্যয় হলেই নানা রোগের আক্রমণ শুরু হয়। সুতরাং আমাদের নিরাপদ খাদ্য অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন-ক্যাব রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, এমন ভ্রাম্যমান ল্যাব সাধারণ মানুষের জন্য আর্শীবাদই, যদি তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। সাধারণ মানুষকে এ সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। যারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে খাবারে ভেজাল দিচেছ বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে নিজ নিজ জায়গা থেকে সোচ্চার হতে হবে। আমার প্রত্যাশা থাকবে, এই ল্যাব নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের প্রশ্নে যুগান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
এ বিষয়ে জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা ইয়ামিন হোসেন বলেন, আমাদের ভ্রাম্যমান পরীক্ষাগারে সব মিলিয়ে ৩৮ ধরনের টেস্ট হয়। তবে বর্তমানে মোট ২৩টি টেস্ট হচ্ছে। বাকিগুলো টেস্ট কিট এলেই শুরু হবে। এরইমধ্যে আমরা তেল, দুধ, বেকিং সোডাসহ বেশ কিছু খাবারের পরীক্ষা করেছি। ক্ষতিকর বস্তুর উপস্থিতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করছি। প্রয়োজনে জরিমানা ও ধ্বংস করছি। একইসঙ্গে এ রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকেও দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সাধারণ মানুষও বিনামূল্যে পরিক্ষা করাতে পারবে। এক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই হবে।