রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
সামীর সীমান্ত
১.
রাত তখন প্রায় ১২টা। আনাফ বসে আছে ছোট্ট একটা কফিশপের এক কোণে। থাইগ্লাসে আঁটা জানালা। তা গলিয়ে বাইরে দৃষ্টি গেলে, দৃষ্টিগোচর হয় শহরের ঝলমলে আলো, মাথার উপর দিয়ে কখনো কখনো দুএকটা বিমানও উড়ে যায়। আর নিচে যে মাটি তাতে লেগে থাকে হাজার আকারের চাকা। তাদের মনে একে-অপরের মধ্যে অনন্তকালের প্রেম। সেসব চাকাও ছুটে চলে দ্রুত বেগে। বাইরে অনেক আলো থাকলেও আনাফের মনটা আজ অন্ধকার। সে অনেকখানিই অন্যমনষ্ক। সামনের কাপে থাকা কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সে দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার খেয়াল শুধু অরিনকে নিয়ে।- ও, সত্যি সত্যি আসবে তো ! না কি ফাঁকি দিবে? আজ তিন বছর পর অরিনের সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। অরিন আসলে কেমন আছে, সে কি আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে ? নাকি, তেমনই আছে আগে যেমন ছিলো। এমন হাজার প্রশ্ন আনাফের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার কাছে মনে হয় এ প্রতীক্ষার সময়, সে বড় শত্রু। সে ফুরাতেই চায় না। একেকটা মুহূর্ত যেন একেকটা বছর বলে তার মনে হয়। তার উত্তেজনার পারদ উপরের দিকে উঠতেই থাকে, উঠতেই থাকে।
অরিন তার প্রথম প্রেম, তার একমাত্র ভালোবাসা। তিন বছর আগে, অরিন হুট করে চলে গিয়েছিল, কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই। কেবল একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল, ‘আমাকে খুঁজতে যেও না। একদিন নিজেই তোমার কাছে ফিরে আসব।’ আনাফ সেদিন বিশ্বাস করতে পারেনি, আজও পারে না। কিন্তু আজ, এতদিন পর অরিন নিজেই তাকে এখানে ডেকেছে। কিন্তু কেন? সে কি নিছক কথার কথা ডেকেছে? নাকি সে এখন পুরোপুরি অসহায় বিধায় আনাফের প্রয়োজন তার কাছে অনেক বেশি ? নাকি সে এখনো ভুলতে পারেনি আমাদের সম্পর্ক? – আচ্ছা. ও আসলেই সব জানা যাবে। আপাতত এখন এখানেই থামি।
২.
কফিশপের দরজায় আঁটা ঘণ্টিটা বেজে উঠল। আনাফ জানালা থেকে মুখ সরিয়ে তাকাতেই দেখল, সামনে অরিন দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা শাড়ি, চোখেমুখে ক্লান্তি, গালগুলো আগের মতই লাল হয়ে আছে, নিষ্প্রভ চোখ তবু সেই চোখের নিচে পুরো মুখ জুড়ে সেই পুরনো ভুবন ভুলানো মায়াবী হাসি। যার আলোকতলে আনাফ ভেসেছিলো একদিন। ওর ঠোঁটের দুরবার আকর্ষণে একদিন হারিয়েছিলো নিজেকে। সেই মোহিনী পরাণ এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে। আনাফ নিজেকে খানিকটা হাত দিয়ে সান্ত¡না দিয়ে, এদিক-ওদিক নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে নিয়ে, কিছুটা স্বাভাবিক প্রস্তুত হয়ে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু পা যেন মাটিতে জমে গেছে। পা দুটো আর সরতেই চায় না। অথচ মন বারংবারই বলছে সামনে যেতে, মুখোমুখি দাঁড়াকে। এমন অবস্থা দেখে অরিন নিজেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো আনাফে দিকে, কেমন আছো, আনাফ?
তার কণ্ঠ কানে আসতেই, আনাফের শরীর জুড়ে এক বিস্ময় শিহরণ খেলে গেল। সেই চিরচেনা স্বর, মায়বী সুর, কিন্তু কোথায় কিসের যেন একটা দুঃখ লুকিয়ে আছে। যা প্রচ্ছন্ন অথচ গভীর, যা মায়াময় অথচ নিবেদিত। আনাফ কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
এবার আনাফ খুব ধীর স্বরে বলল, ‘তোমার খোঁজ পাওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারছি, তুমি ভালো নেই’। তুমি কি একটি বারের জন্য হলেও আমাকে ভুলে থাকতে পেরেছিলে? হঠাৎ করেই কোনো কিছু না বলে উধাও। এতে কার কতটুকু লাভ হয়েছে আমি জানি না তবে আমার যে শতভাগ ক্ষতি হয়েছে একথা আমি হলপ করেই বলতে পারি। তুমি কি ভুলে গেছ সে সময়ের সব স্মৃতি? এমন কষ্ট দেওয়ার অর্থ কি, একটু কি জানতে পারি?
অরিন এবার একটু হাসল, ‘জানতাম, তুমি এমন কিছু বলবে। আচ্ছা বাবা হয়েছে, এখন চলো কোথাও গিয়ে একটু বসি, তারপর মর খুলে সব কথা বলি’
সামনেই একটা বটগাছ এবার তার নিচে তারা বসলো, কিন্তু কে, কি কথা বলবে বুঝে উঠতে পারচ্ছে না। কে-ই বা প্রথম কথা বলবে তাও ঠিক করতে পারচ্ছে না। এমন দ্বিধার মধ্যে কেটে গেল অনেক সময়। এভাবে তারা মুহূর্তর পর মুহূর্ত কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলো। শুধু নিঃশব্দে তারা একে অপরকে দেখল, যেন চোখের ভাষায় গত তিন বছরের সব শূন্যতা পূরণ করতে চাইছে।
৩.
“তুমি চলে গেলে কেন?” অনেকক্ষণ পর আনাফ প্রশ্ন করল। অরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তখন বলতে পারিনি, কিন্তু এখন বলা দরকার।” তারপর একটু থেমে বলল, “আমার মরণব্যাধি ক্যানসার হয়েছিল, আনাফ। ডাক্তাররা বলেছিল খুব কম সময় বেঁচে থাকবো। আমি চাইনি, তুমি আমার জন্য কষ্ট পাও, আমার না থাকার ব্যথা তুমি যেন সহ্য করে নিতে পারো। তাই তোমার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম।”
এ কথা শোনার পর আনাফের দেহ থেকে শ^াস উড়ে গেল, অসাড় হয়ে এল পুরো দেহ। “এত বড় বিপর্যয় আর তুমি… তুমি আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”
অরিন জল ছলছল চোখে বলে উঠলো, “তুমি যদি জানতে, তাহলে আমাকে যেতে দিতে চাইতে না। আমি জানতাম, তুমি আমার শ^াসবায়ু শক্ত করে চেপে ধরে রাখতে। প্রয়োজনে তোমার জীবন আমার জন্য উৎসর্গ করে দিতে। আর আমি সেটা চাইনি, তাই দূরে সরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে চলে গিয়েছিলাম।”
“কিন্তু অরিন, তুমি তো এখনো বেঁচে আছো, এটা তাহলে কিভাবে সম্ভব হলো!”
অরিন এবার মুখের কোলে সামান্য একটু হাসি এনে বলল, “হ্যাঁ, অলৌকিকভাবে আমি এখনো বেঁচে আছি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষতা, আধুনিক কেমোথেরাপি চিকিৎসা -সব মিলিয়ে আমাকে এখন একটা নতুন জীবন দিয়েছে। আমি আবার আগের মতই চলাফেরা করছি, খাচ্ছি, উঠছি বসছি সব কিছুই করছি তারপরও কোথাও কি যেন একটা নেই, কিসের যেন অভাব, বারবারই এমনটা মনে হচ্ছিল আর তাই তো একটা জিনিসই আমাকে সারিয়ে তুলতে পারেনি – আর তা হলো তোমার অনুপস্থিতি। তুমি নাই বলে আমার সবকিছুই যেন থেমে ছিলো। তোমার প্রয়োজন তুমি না থাকাতে তা তিলে তিলে অনুভব করেছি। আর এ সবই আমার ব্যর্থতা, আমিই বোধকরি তোমার ঠিক মত মন বুঝতে পারিনি”
আনাফ চুপ করে রইল। তার চোখেও জল টলমল করছে।
৪.
অরিন হাত বাড়িয়ে আনাফের হাত ধরল। “আমি জানি না, এতদিন পর আমি তোমার কাছে ফিরে এসে ঠিক করেছি কিনা। হয়তো আমার সাহস ছিল না আগে তোমার সামনে আসার। কিন্তু জানো, প্রতিদিন তোমাকে মিস করেছি। প্রতিটি মুহূর্ত বোধ করেছি তোমার অভাব। তুমিহীনা জীবনের কোনো অর্থই খুঁজে পাইনি এতদিন। তোমার কথা ভেবে ভেবে কাটিয়েছি সারা রাত। আমার শয়নে-স্বপনে, ধ্যানে, জাগরণে সব সময় ছিলে শুধুই তুমি”
আনাফ ধীরে ধীরে অরিনের হাতটা শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরল। “তুমি এরকমভাবে সব সময় আমার পাশে থেকো? থেকো আমার সাহস হয়ে, আমার শ^াস হয়ে”
অরিনের চোখে বিস্ময়, “তুমি কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?” আনাফ একটু হাসল, “ভালোবাসায় ক্ষমার দরকার হয় না। দরকার হয় শুধু পাশে থাকার। তুমি আমার পাশে আছো, এই তো আর কি চায়” অরিন আর কিছু বলতে পারল না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আনাফের দিকে, আর তাদের মাঝে জমে থাকা তিন বছরের দূরত্ব এক মুহূর্তে যেন মিলিয়ে গেল। দ্রুতই নিকটবর্তী হতে থাকলো সম্পর্কের আকাশ মাটির মুখোমুখি। গলতে থাকলো জমে থাকা অভিমানের মোম। আর ঘরমুখো পাখির মত দুজনের ভালোবাসা একই নীড়ে নতুন করে রচনা করলো স্বপ্নের উদার ভূমি। সেই রাতে শহরের সব আলো যেন আরও উজ্জ্বল লাগছিল, যেন তারাও সাক্ষী ছিল তাদের ভালোবাসার নতুন শুরুতে।