তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠির জন্য পৃথক টিকিট কাউন্টার রাজশাহীর দৃষ্টান্তে উদ্ভাসিত হোক দেশ

আপডেট: জানুয়ারি ২৪, ২০২৩, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আশান্বিত হওয়ার কথা এই যে, পরিবর্তনটা হচ্ছে। সেটা ইতিবাচকভাবেই হচ্ছে। নানা লিঙ্গ, বর্ণ ও বৈশিষ্ট্যের মানুষ তাদের নিজের মত করে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাবে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। এ ক্ষেত্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক সোনার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠির জন্য পৃথক টিকিট কাউন্টার খোলা হয়েছে। ২২ জানুয়ারি হাসপাতালের বর্হিবিভাগে এ টিকিট কাউন্টারের উদ্বোধন করেন, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বিশিষ্ট সমাজসেবী শাহীন আকতার রেনী ও হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। দেশের সরকারি কোনো হাসপাতালে এই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক টিকিট কাউন্টার খোলা হলো। ফলে বলাই যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি যুগের সূচনা করলো। এটাকে মানবিক কর্মের সূচনাও বলা যায়। এ ক্ষেত্রে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে থাকলো। এই পরিবর্তন দেশের অন্য হাসপাতালগুলোকে উৎসাহিত করবে- এ আশা করাই যায়।
মানুষের মধ্যে লিঙ্গবৈচিত্র্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের সব দেশ ও সমাজে এটা আছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠিকে বিভিন্ন কুসংস্কার ও সহিংসতার শিকার হতে হয়। এরা সমাজের মূল স্রোত থেকে আলাদা। এ জন্য দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ে। আবার বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত অংশও এই জনগোষ্ঠি। জন্মের সময় হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর লিঙ্গ যেভাবে নির্ধারিত হয়, পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের সেভাবে প্রকাশ করে না। সারা বিশ্বে তারা সমাজ ও পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। এ জন্য শিক্ষা, চাকরি ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ডে অর্থবহভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারা নিজেরা নিজেদের কমিউনিটির বলে পরিচয় দেয়।
সরকার এই জনগোষ্ঠির সমস্যাসমূহ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অবস্থান থেকেই দেখছে। এরফলে সমাজে একটা ইতিবাচক ধারাও তৈরি হয়েছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের এই উন্নত সূচনা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকেই। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী। ২০১৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে হিজড়া লিঙ্গ স্বীকার করে নেয়। বহু যুগ ধরে প্রান্তিক থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার পর এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বেঁচে থাকার জন্য তারা অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তারা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়। এ জন্য তাদের বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়। সরকার তাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করেছে। এ জনগোষ্ঠীর অনেক পরিবারকে সরকার থেকে ঘর দেয়া হয়েছে। এখন তারা চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছে। কিন্ত এখনো তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
মূল স্রোতধারার মানুষেদের মধ্যে সেই চিন্তার উদ্রেক হয়েছে যে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে হিজড়া জনগোষ্ঠিসহ পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠিকে মূল স্রোতধারায় আনতে হবে। চিন্তার ক্ষুদ্রতা এখনো ব্যাপকভাবে আছে। কিন্তু চিন্তার প্রসারও হচ্ছে। হেজড়া জনগোষ্ঠির অধিকারের বিষয়টিও সরকার ও দেশের মানুষের কাছে স্বীকৃত হচ্ছে। এটা ক্রমান্বয়ে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন। সমাজের ধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমাগত সম্পৃক্তি ছাড়া টেকসই উন্নয়নও যে সম্ভব না বিশ্ব মানবসমাজ সেটা মানছে। সেই নিরিখেই বাংলাদেশেও বিষয়টির সামাজিকীকরণ হচ্ছে। এটা মানুষ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব যে, পিছিয়ে পড়া মানুষদের আর পিছিয়ে রাখা যাবে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বটি ক্রমাগত পালন করে যেতে হবে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিজড়া জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্যসেবায় যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন তার জন্য তারা শুধুই প্রশংসা পেতে পারেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ