সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১০ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
মাঝে মাঝে মনে হয় এই ডান পা টা-ও কেটে ফেলি। এমন তীব্র ব্যথা হয়। রাতে একটুকু ঘুমাতে পারিনা। তীব্র যন্ত্রণায় সারা রাত চিৎকার করতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ডান পা-ও ক্ষতবিক্ষত হয়। তিনটা রড ঢুকিয়ে কোনোরকমে সচল করেছেন চিকিৎসকরা। দুর্ঘটনার পর ৬ মাস হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আরো ৬ মাস বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এই এক বছর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি।
এমনভাবেই নিজের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বলছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় বাম পা হারানো রাজশাহী পুঠিয়ার গোপালহাটি গ্রামের ফিরোজ ইসলাম (২৪)। তার বাবার নাম হাসিব উদ্দিন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নসিমন ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হন তিনি। এই দুর্ঘটনায় তার বাম পা কেটে ফেলতে হয়। ডান পা-ও ক্ষতবিক্ষত হয়। তিনটা রড ঢুকিয়ে সচল করতে হয় ডান পা। এর মধ্যে ডান পা থেকে একটা রড বের করেছেন চিকিৎসকরা। অন্য দুইটা রড এখনো পায়ে ঢুকানো রয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার আগে এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন ফিরোজ ইসলাম। অন্যের বাসায় কাজ করে সংসারের খরচ চালিয়ে নিজের পড়াশোনা করেছেন। অমানুষিক পরিশ্রম করলেও পড়ালেখা ছাড়েননি কখনো। অথচ সেই মানুষকেই একটি দুর্ঘটনা স্তব্ধ করে দেয়। দুর্ঘটনায় পা হারান তিনি। তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে দীর্ঘ এক বছর পর তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠেন। কিন্তু পা আর ফিরে পান না। তাই বলে তো জীবন তো থেমে থাকে না। তার স্বভাবই এগিয়ে যাওয়া। তাই তো পা হারিয়েও জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে প্রস্তুত করেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।
ফিরোজ জানান, কোনোদিন ভাবিনি ভালোভাবে সুস্থ হতে পারব। উঠে দাঁড়াতে পারব। কারণ এই একবছরে বাইরে বেড়াতে ইচ্ছা করলেও তা সম্ভব হয় নি। অথচ সংসারে অভাব লেগেই আছে। অভাবের কারণে ছোট ভাইদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। তাই নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করি। আগে জমিতে চাষ দেওয়ার জন্য পাওয়ার টিলার চালাতাম। সুস্থ হয়ে আবার তাই চালানোর চেষ্টা করি।
ফিরোজ জানান, পাওয়ার টিলার চালানোর সময় শুরুতে সমস্যা হলেও এখন আর তেমন সমস্যা হয় না। এক পায়ে চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে না চালিয়ে উপায় নেই। তাই ঝুঁকি নিয়েই টিলার চালাই। তবে খুব দুঃচিন্তায় আছি। তিন মাস পর আবার পায়ে অপারেশন করাতে হবে। এমনিতে সংসার চলে টেনেটুনে। তার ওপর এই অপারেশন করাতেই হবে। তাই শত কষ্ট হলেও কাজ করে টাকা জমানোর চেষ্টা করছি।
ফিরোজ জানান, কাটা পা নিয়েই টিলার চালালেও কাটা পা ও রডের কারণে মাঝে মাঝে পায়ে তীব্র ব্যথা হয়। তখন মনে হয় এই ডান পা টা-ও কেটে ফেলি। সব ব্যথা সয়েই প্রাণপণ কাজ করে যাই।
ফিরোজ জানান, দুর্ঘটনার পর টিলার চালাতে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছে। পায়ে খচ খচ করে ব্যথা হত। এখন তেমন কষ্ট পায় না। পৌরসভা ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিরা সরকারি সাহায্যের কথা বললেও তাদের কেউ সাহায্য করেন নি। অনেকবার সাহায্যের জন্য পৌরসভায় গেছি কিন্তু কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। শুধু ঘুরিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই এখন আমি চেষ্টা করছি কারো সাহায্য ছাড়াই বেঁচে থাকার। সুস্থ থাকার সময় কারো কাছে সহযোগিতা নিই নি। পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করেছি। এখনও কারো সাহায্য চাইব না। এক পা দিয়েই সব কিছু করার চেষ্টা করবো।
ফিরোজ জানান, দুর্ঘটনার পর থেকে ৭ মাসে ৪৩ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপতিবেশীরা সহযোগিতা করেছে। চিকিৎসার সময় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ওই সময় পরিবারের যা কিছু জমিজমা ছিল বিক্রি করে চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে হয়েছে।