মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোহাগ আলী, রাবি:
তখন রাত ৯টা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পরিবহন চত্বরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন অনেকে। হঠাৎ ছয়-সাত বছর বয়সী এক শিশুর কণ্ঠে শোনা যায়, ‘বাদাম, বাদাম!’ চোখে একরাশ ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তার সমবয়সী অন্য শিশুরা যখন বাবা-মায়ের আদরে বেড়ে ওঠে, তখন বাস্তবতা ও দরিদ্রতার বেড়াজালে বাদাম বিক্রিকেই বেছে নিতে হয়েছে তাকে। অথচ স্কুলে গিয়ে দশ-পাঁচটা শিশুর মতোই পড়ালেখা করতে চেয়েছিল শিশুটি।
শিশুটির নাম মুরসালিন। ছোট্ট এই শিশুটি ক্যাম্পাসের বাদাম বিক্রেতা। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকে মুরসালিন। তার মায়ের নাম মেরিনা আক্তার ও বাবার নাম বদিউল আলম। বাবা পেশায় রিকশাচালক। দুইটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গেই থাকেন। মুরসালিনের ছোট আরেকটি ভাই রয়েছে। নাম মিনারুল। বয়স ৮ মাস।
মুরসালিনের কাছে জানতে চাওয়া হয় স্কুলের বিষয়ে। সরল ও সাদামাটাভাবে শিশুটি জানায়, তার অনেক ইচ্ছা সে স্কুলে যাবে। কিন্তু যেতে পারে না। না যাওয়ার কারণ বিষয়ে মুরসালিন জানায়, তার মা স্কুলে যেতে মানা করেছে। অন্যান্য শিশুদের মতো তারও স্কুলে যেতে মন চায়। এর কিছুক্ষণ পর মুরসালিনের মা ও নানি এসে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।
মুরসালিনের মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুরসালিনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। বাবা রিকশা চালান, নিজে অন্যের বাসায় কাজ করেন। নিজেদের খাবার জোগানোই তাদের কাছে সংগ্রামের। মুরসালিনকে স্কুলে পাঠাতে চাইলেও অর্থের অভাবে তা সম্ভব হয় না।
মুরসালিনের মা বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে স্কুলে দেওয়ার। কিন্তু, মুরসালিনের বাবা ওর টিকা কার্ড ও জন্ম সনদ হারিয়ে ফেলেছেন। একবার কাগজের জন্য গিয়েছিলাম, কিন্তু অফিসের লোকজন বলেছেন, এসব করতে ৫ হাজার টাকা লাগবে। আর কোথায় কোথায় যেতে বলে আমি চিনিও না। মহিলা মানুষ একা কোথায় আর যাব! মায়ের এমন কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, দারিদ্র্যের পাশাপাশি নানা জটিলতাও মুরসালিনের স্বপ্ন পূরণে যেন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মেরিনা আক্তার বলেন, মুরসালিনের বাবার আরেকটা সংসার আছে। সেখানেই বেশিরভাগ সময় থাকেন। ওইখানেও তার ছেলে-মেয়ে আছে। আগে কাজ থাকলেও এখন তেমন কাজ নেই। কষ্ট করি, বাঁচতে তো হবে। মরে তো আর যেতে পারব না। মুরসালিনও আমার কাছে টাকার বায়না করে। নিজেদের চলতেই হিমশিম খেতে হয়। এদিকে ওর কাগজপত্র না থাকার কারণে মাদ্রাসায়ও দিতে পারি না। তাই বাধ্য হয়েই মুরসালিনকে বাড়িতে না থেকে বাদাম বিক্রি জন্য পাঠাতে হয়।
সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে গল্পে মুরসালিনের নানি যোগ করেন, আগে থাকতাম বাগেরহাট জেলায়। সেখানে বন্যায় আমাদের বাড়িঘর তলিয়ে যায়। সেখানে আর থাকার জায়গা নেই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ভবনের পাশে আমরা থাকা শুরু করি। কিন্তু, মহাসড়ক নির্মাণের সময় আমাদের উচ্ছেদ করে দেওয়া হয় ওখান থেকে। এখন অন্যের বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। কী করব বাবা, কিছুই করার নেই। থাকতে তো হবেই!
মুরসালিনের স্বপ্ন শুধু তার নিজের নয়, গোটা একটা পরিবারের স্বপ্ন। সমাজের অন্যান্য পরিবারের মতো তার পরিবারও চায়, সন্তানরা ভালোভাবে পড়াশোনা করে মানুষ হোক। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে তাদের স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। শুধু মুরসালিনই নয় আমাদের সমাজে তার মতো অনেক শিশু আছে যারা স্বপ্ন দেখে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পায় না।
মুরসালিনদের মতো শিশুদের সমাজের অন্যদের মতো নেই কোনো অট্টালিকার চাহিদা। নেই অঢেল সম্পদ গড়ার ইচ্ছা। এমন মুরসালিন আছে বলেই আমাদের চারপাশ এত সুন্দর। তাদের মতো শিশুরাই পৃথিবীর আসল ফুল। তাদেরকে ফুটতে দেওয়া উচিত। বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। তারাই প্রকৃতির সুন্দরতম সত্তা।