দার্জিলিং-এ কিছুটা সময়

আপডেট: জানুয়ারি ১৯, ২০১৭, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ

শুভ্রারানী চন্দ


দেশ ভ্রমণের আগ্রহ কোন নতুন বিষয় নয়। অনেককে এটা নেশার মত পেয়ে বসে। কম বেশি নেশাগ্রস্ত আমি এবং আমার পরিবার। সময় ও সুযোগ এলে সেটা কাজে লাগাই আমরা। তারই ধারাবাহিকতায় এ মাসের ২-৫ তারিখ ঘুরে এলাম পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং। অনেক দিনের একটা ইচ্ছে পূরণ হলো। ইতিপূর্বেও দার্জিলিং যাবার একটা ছোট্ট সুযোগ এলেও কাজে লাগাতে পারিনি। এবারে তাই পূর্ব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটেছে। তবে সীমিত সময়ের জন্য। সময় কম হলেও প্রাপ্তি অনেক।
২৬/১২/২০১৬ কোলকাতায় যাই চিকিৎসার জন্য। ২৭/১২/২০১৬ তে এ্যাপোলো হাসপাতালে ডাক্তার দেখালে উনি কিছু টেস্ট দেন এবং ২/১/২০১৭ তারিখ পর্যন্ত কোলকাতায় থাকবেন না বলে জানান। প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো করিয়ে ৬/১/২০১৭ তারিখ বিকেলে ডাক্তারের অঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ নিয়ে ২/১/২০১৭ তারিখ ডার্জিলিং যাবার সিদ্ধান্ত নিই।
ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় অগত্যা ঝঢ়রপব ঔবঃ ধরৎধিুং-এ ২/১/২০১৭ তারিখ বিকেল ১.০০ মি. মিনিটে রওয়ানা হই দার্জিলিং। ১ ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছালাম বাগডোগরা বিমান বন্দরে। সত্যি কথা বলতে কি বিমান ভ্রমণ কখনোই আমাকে আকৃষ্ট করে না। কারণ বিমানভ্রমণের যে পথটা পাড়ি দিয়ে কোথাও যাই তাতে কোন কিছুই দেখার সুযোগ হয় না- যা সম্ভব অন্যান্য যে কোন পরিবহন মাধ্যম, বিশেষ করে সড়ক পরিবহন। সুতরাং, একটা আফসোস থেকেই গেল।
বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে পূর্বেই ভাড়া করে রাখা গাড়িতে আমরা যাত্রা শুরু করলাম দার্জিলিং এর পথে। গাড়ির চালক অল্পবয়সী একটি নেপালী ছেলে নাম ওয়াংগেল। গাড়ি ছুটে চললো দার্জিলিং এর পথে। বেশ কয়েক মাইল সমতলভূমি পেরিয়ে প্রবেশ করলাম পাহাড়ি পথে। ওই সমতলভূমির দু’ধারে ছিল চা বাগান। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে চলতে চলতে লক্ষ্য করলাম পাহাড়ের গায়ে গায়ে ফুটে আছে নাম না জানা বিচিত্র বর্ণের সব ফুল, যার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য হৃদয় মনকে প্রশান্ত করে এক অদ্ভুত ভালোলাগায়। কোথাও বা পাহাড়ি নদীর কুলকুল ধ্বনি, তার স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো জলের ধারা, পাহাড়-পর্বতের উঁচুনিচু ঢাল বেয়ে তন্বী মেয়ের মতো ছুটে চলা এক মোহময় আবেশ সৃষ্টি করে। কখনও আমরা এগিয়ে চলেছি হাজার হাজার ফুট উপরের পাহাড়ি পথে। নিচের দিকে তাকালে ভয়ে বুক হিমশীতল হয়ে যায়। কারণ কোনভাবে যদি গাড়িটা একটু বেগতিক হয় তাহলে আমরা তলিয়ে যাব হাজার হাজার ফুট নিচের কোন গভীর জঙ্গল খাদে। যেখান থেকে বেঁচে ফেরাটা দুঃসাধ্যই নয়, দুঃস্বপ্নও বটে।
চলার পথের অন্য সাথী পাহাড়ি মেঘ। কোথাও পেজা তুলোর মত সাদা মেঘ, কোথাও ঘন নীল, কোথাও বা ঘন কালো। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে এক টুকরো কালো মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো পথ-ঘাট। আবার মুহূর্তেই সে উধাও। সে এক মিষ্টি লুকোচুরি খেলা। শুনেছি এ মেঘ এমনি দুষ্টু- কারো জানালা খোলা পেলে টুক করে ঢুকে পড়ে ঘরে, ভিজিয়ে দেয় বিছানা। সে অভিজ্ঞতা হয়নি বটে। তবে এটা দেখেছি চারিদিকে ঝলমলে রোদ, হঠাৎ কোথাও এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো সব। এমনি করে সন্ধ্যের একটু পরে পৌঁছলাম আমরা আমাদের গন্তব্যে।
রুম বুকিং দেয়া ছিল হোটেল চরহবৎরফমব -এ। বৃটিশ আমলে তৈরি বিশাল হোটেল, এমনকি তার আসবাবপত্রেও সে ঐতিহ্যের ছাপ সুস্পষ্ট। কোলকাতার হালকা শীত পেরিয়ে দার্জিলিং পৌঁছে হাড়-কাঁপানো শীতে আমরা খানিকটা পর্যদস্ত হয়ে পড়লাম। রুমহিটারের ব্যবস্থা না থাকলেও ছিল ফায়ারপ্লেস। অগত্যা তারই সাহায্য নিয়ে শীতের তীব্রতা থেকে খানিকটা নিস্তার পাবার চেষ্টা করলাম আমরা। পরদিন ভোর চারটায় আমরা টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওয়াংগেলকে বিদায় জানালাম। রাতের খাবার শেষে একটু তাড়াতাড়িই আমরা ঘুমোতে গেলাম। একদিকে যাত্রা পথের ক্লান্তি এবং অন্যদিকে খুব ভোরে ওঠার তাড়া- খুব দ্রুতই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সাড়ে তিনটেয় ওঠে তৈরি হয়ে নিচে নেমে খানিকটা এগিয়ে ওয়াংগেলকে পাওয়া গেলো। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাতের নীরবতা ভেঙ্গে গাড়ি এগিয়ে চললো টাইগার হিলের দিকে। যখন আমরা পৌঁছলাম তখন গাড়ির বিরাট লাইন পড়ে গেছে। অনেক মানুষ এসে পৌঁছেছে একটা পাহাড়ের উপরে যেখান থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য একটা নির্মাণাধীন টাওয়ার আছে। খানিকটা হেঁটে সামনে এগিয়ে মানুষজনের ভীড় ঠেলে একটা সুবিধেজনক জায়গায় দাঁড়ালাম আমরা (আমি, আমার মেয়ে ও তার বাবা)। ক্রমে ক্রমে মানুষের ভীড় বাড়তে লাগলো- তিল ধারণের ঠাঁই নেই কোথাও। দার্জিলিং ঘোরার অনুপযুক্ত সময়েও এ পরিমাণ ভীড় না দেখলে বিশ্বাস হয় না। পাহাড়ের ওই নির্দিষ্ট পয়েন্টে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় ঠিক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। অত্যন্ত বিপজ্জনক সে জায়গা, একটু পিছলে গেলেই আশ্রয় হবে হাজার হাজার ফুট নিচে। উৎসাহী মানুষেরা কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে উঠছে। চিৎকার শুনে মনে হলো এই বুঝি সূর্য উঠছে। কিন্তু না তখনও আকাশে ফুটে রয়েছে অসংখ্য তারার ফুল।
সুতরাং, অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে। সময় এগিয়ে যাচ্ছে আপনগতিতে। আকাশ পরিস্কার হচ্ছে। কখনো কখনো ঘন কুয়াশা আর কালো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে আকাশ। আবার কখনো সেগুলো সরে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আকাশে লাল আলোর একটা চিকন রেখা জেগে ওঠে।
উৎসাহী ও উৎসুক মানুষেরা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে। পর মুহূর্ত কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় আলোর রেখাটি। হতাশ হয় মানুষ। এমনি মেঘ আর কুয়াশার খেলা চললো, বেশ খানিকক্ষণ। অবশেষে এলো সেই বহুল আকাক্সিক্ষত মুহূর্তটি। সব কুয়াশা আর মেঘকে সরিয়ে ফুটে উঠলো সিঁদুর বর্ণের মেঘের ছটা আর সে মেঘকে ভেদ করে আস্তে আস্তে কমলাকৃতির সূর্যটি উদিত হলেন এবং উদয়ের সাথে সাথে আবার অস্তও গেলেন। অর্থাৎ পূর্ণ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে এক খ- কালো মেঘ সূর্যকে ঢেকে দিলো। ওই যে কয়েকটি মুহূর্ত মনের গভীরে যে গভীর রেখাপাত করলো তার বেশ থাকবে বহুদিন মনের গহীনে। দিনের আলো ফোটাবার সাথে সাথে দৃশ্যমান হলো কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য্য। বরফাবৃত পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলো পড়ে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করলো। মূলতঃ সূর্যোদয়ের পর পরই কমতে থাকে মানুষের ভীড়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আমরাও ফিরলাম হোটেলে।
এখানে পরের দিন সকালে গেলাম মিরিখে। যেখানে আছে একটা লেক, যাতে রয়েছে নৌকা ভ্রমণের সুব্যবস্থা। আছে পিকনিক স্পট ও ঘোড়া চালানোর সুযোগ।
মিরিখ যাবার পথে একটা হোটেলে আমরা সকালের খাবার খেলাম। এ হোটেলের খুব কাছেই ছিল নেপালের সীমান্তসীমা।
মিরিখ থেকে ফেরার পথে কয়েকটা চা বাগানে নামলাম-একটা বাগানের চা পাতার সাথে অন্যটির মিল নেই। স্বাদে-গন্ধেও আছে এদের বৈচিত্র্য। দু’জাগায় থেমে দু’বাগানের চায়ের স্বাদ গ্রহণ করলাম। কিছু চা কিনলাম। সর্বত্রই ছিল নজরকাড়া সব বিচিত্র ফুলের মনকাড়া রঙ ও সৌন্দর্য্যরে বাহার। ওখানকার বাড়িগুলো তৈরিরও একটা বিশেষত্ব আছে। বাড়িগুলো সব একই লেভেলে না হওয়ার আকাশসহ প্রকৃতি এবং তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার এক বিরল সুযোগ আছে ওখানকার বাসিন্দাদের।
আর একটা মজার বিষয় ছিল হোটেলের জানালা দিয়ে তাকালে বাইরের যে দৃশ্যটি সব চেয়ে চিত্তাকর্ষক ছিল তা হলো দূরের বরফে ঢাকা পাহাড়। ওই পাহাড়ের উপর সূর্যের আলো পড়ে এক মনোহারী দৃশ্যের অবতারণা হতো। আবার রৌদ্রের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে বরফ গলে পাহাড়ের প্রকৃত রূপ দৃশ্যমান হতো। সবুজে সবুজে ঢাকা পাহাড়। দূরের সাদা মেঘকে কখনো কখনো মনে হতো সামান্য দোলায়মান জলরাশি বা সমুদ্র। কখনো কখনো বা সে জলরাশি স্থির অনড়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যেত ওটা কোন সমুদ্র বা জল নয় ঘনীভুত মেঘমালা।
দার্জিলিং-এ যাবার পূর্বে শুনেছিলাম টাইগার হিলে সূর্যোদয দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। অনেকেই বহুবার গিয়েও সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু প্রথমবার গিয়েই আমরা সে বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। ওখানকার স্থানীয় মানুষ অসম্ভব পরিশ্রমী। ঘাড়ে করে তারা ভারী ভারী জিনিস স্থানান্তর করে। তারা বেশি রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখে না সম্ভবতঃ ঠান্ডার কারণে। প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ি একটা করে ব্যবসা কেন্দ্র।
বাড়িগুলোর সাথেই আছে তাদের কাজের ব্যবস্থা। নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা আছে- সেখানে আছে থাকা ও খাবার সুব্যবস্থাও। অনেকের মতে দার্জিলিং তার সৌন্দর্য্য হারিয়েছে অনেকটা। আমাদের বেশ ভালো লেগেছে। হতে পারে সেটা প্রথমবার যাবার জন্য। অবশেষে বিদায়ের সময় হলো। ৫ তারিখ খুব সকালে উঠে হোটেল থেকে বেরিয়ে আশেপাশের জায়গাগুলো দেখে নিলাম হেঁটে হেঁটে যতটা দেখা সম্ভব। সকাল সাড়ে দশটা ৫/১/১৭ তারিখ বিদায় নিয়ে আবার ওয়াংগেলকে সঙ্গী করে চলে এলাম বাগডোগরা বিমান বন্দরে। ওয়াংগেলকে বিদায় জানালাম। চমৎকারÑ একটি ছেলে, শান্ত, সৎ ও নির্লোভ। বিমান বন্দরের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা সেরে ওখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে ৩-৪০ মিনিট এড় রহ ধরৎধিুং-এ উঠে পড়লাম। ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট যাত্রার পর আমরা পৌঁছে গেলাম জওহরলাল নেহেরু বিমানবন্দরে।
দার্জিলিং-এর সৌন্দর্য্য অপূর্ব। আবার সেখানে যাবার ইচ্ছে থাকলো সময় ও সুযোগ হলে।