দীর্ঘ লড়াইয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, চূড়ান্ত জয় অধরা

আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২৪, ৯:১৩ অপরাহ্ণ

লেবানন সীমান্তে ইসরায়েলি সেনা। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

সোনার দেশ ডেস্ক:


গত ৭ অক্টোবর যখন হাজার হাজার হামাস সমর্থিত সশস্ত্র যোদ্ধা গাজার সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলি বসতি, সেনা ঘাঁটি এবং একটি সংগীত উৎসব দখল করে নেয়, তখন অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই হামলার সময় অনেক নিহত ব্যক্তি তাদের আত্মীয়দের কাছে লুকিয়ে থেকে মরিয়া বার্তা পাঠান, ‘বাহিনী কোথায়?’ তাদের উদ্ধার হতে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অনেকের কাছে উদ্ধারকারী বাহিনী পৌঁছায়নি কিংবা এসে থাকলেও অনেক বিলম্বে।

ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক ও গোয়েন্দা বিপর্যয়ের এক বছরেরও বেশি সময় পর দেশটি একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের পুনরায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রতিপক্ষের গোপন ও সুরক্ষিত স্থানে গোপন তথ্যভিত্তিক অভিযানের মাধ্যমে আক্রমণ চালিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নির্মূল করেছে, তাদের সম্পদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে এবং প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা অনেকটাই ব্যর্থ করে দিয়েছে।

সম্প্রতি ইসরায়েল একটি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে। বৈরুতের ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি ভূগর্ভস্থ বাংকারে হামলা করা হয়েছিল। অপারেশনের গোপন কোড নাম ছিল ‘নিউ অর্ডার’, যা ইসরায়েলের লক্ষ্যকে তুলে ধরেছে—দেশের সীমান্তের পরিস্থিতির পরিবর্তন করা এবং ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা।
এখন ইসরায়েল একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রদের সহায়তায় দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মঙ্গলবার ইরান থেকে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্রের একটি বড় প্রতিশোধমূলক হামলা ঠেকাতে সফল হয়। এই হামলার ফলে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সিনিয়র ফেলো অ্যাসাফ অরিয়ন বলেন, ৭ অক্টোবরের আগের সেই শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান ইসরায়েল ফিরে এসেছে। নাসরাল্লাহর মৃত্যু ইসরায়েলের শত্রুদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছে যে, আপনাদের বুঝতে হবে, ইসরায়েল আপনাদের কাছে পৌঁছাতে পারে।

আন্তর্জাতিক সমালোচনা
নাসরাল্লাহর হত্যার পর ইসরায়েলি সেনাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে ও সামরিক বাহিনী দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ইসরায়েলি সেনাদের সৈকতে উল্লাসের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের ৮৭ শতাংশ ইহুদি নাগরিক সামরিক বাহিনীর প্রতি উচ্চ মাত্রায় আস্থা প্রকাশ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি এমন আস্থা মাত্র ৩৭ শতাংশ।
তবে, অরিয়ন বলেন, সামরিক কার্যক্রম একটি ‘দীর্ঘ লড়াই’ এবং এর স্পষ্ট ফলাফল নেই। তিনি বলেন, লেবাননে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সাফল্যগুলোর পর প্রশ্ন হচ্ছে, ‘এরপর কী?’
গত এক বছরে হামাসের আক্রমণের প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় একটি দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ পাল্টা হামলা চালিয়ে আসছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা হামাসের সামরিক অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ধ্বংস করেছে, যা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলি আগ্রাসণে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। মন্ত্রণালয় যোদ্ধা ও বেসামরিক নিহতের তথ্য আলাদা প্রকাশ করে না। এই মৃত্যুর সংখ্যা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখোমুখি করেছে। নেতানিয়াহুর ‘পরিপূর্ণ বিজয়ের’ দাবির পরও সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছিলেন, একটি মতাদর্শ ও আন্দোলন হিসেবে হামাসকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।

লেবাননে যুদ্ধ ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ লেবাননেও চলছে। গত ৮ অক্টোবর থেকে হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের অবস্থানে রকেট, ড্রোন ও গোলাবর্ষণ করে আসছে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুঁড়েছে। সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে হামলা চালিয়ে সেখানে অনেক ইরানি সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরায়েল। এরপর এপ্রিলে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের দিকে সরাসরি হামলা চালায়।

নাসরাল্লাহর হত্যার পর ইসরায়েল তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ইসরায়েল প্রায় হিজবুল্লাহর কমান্ড কাঠামো নির্মূল করেছে এবং হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করেছে। কোনও সন্দেহ নেই, আজকের হিজবুল্লাহ আগের সপ্তাহের হিজবুল্লাহ নয়।
সামরিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ইসরায়েলের শক্তিশালী অবস্থান পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। যা ইরান ও এর সহযোগীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সুরক্ষা হিসেবে কাজ করছে। তবে হিজবুল্লাহ এখনও ইসরায়েলের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
অপরদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইসরায়েলের সামরিক বিজয়গুলোকে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদী কূটনৈতিক সমাধানে পরিণত করা যায়, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। অরিয়ন বলেন, যথাযথভাবে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পাওয়াই চ্যালেঞ্জ।

বর্তমানে ইসরায়েলের সামনে একটি জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যুদ্ধের সমাপ্তি ও গাজায় হামাসের হাতে ১০০ জনেরও বেশি জিম্মি রয়েছে। যুদ্ধের কোনও অবসানের ইঙ্গিত এখনও দেখা যাচ্ছে না। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ৩৫০ সেনা নিহত হয়েছে এবং ইসরায়েলের ইতিহাসের এই বিশাল সামরিক অভিযানটি এখনও পুরোপুরি সফল হয়নি।
ইসরায়েল যদি লেবাননে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ১৯৮২ সালের লেবানন অভিযান শেষে ১৮ বছর পর তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর একটি আক্রমণ আবারও ইসরায়েলের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা করে।
তথ্যসূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস, বাংলাট্রিবিউন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ