দুঃসাহসী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আফজালের আত্মকথা

আপডেট: ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬, ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ

আব্দুল্লাহ হেল বাকী, ধামইরহাট :


      
বাস্তব সত্য কখনো কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনের বীরত্বের স্মৃতিকথা তেমনি অবিশ্বাশ্ব্য মনে হলেও সত্য। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৫৬ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের কোল ঘেঁষে ধামইরহাট উপজেলার অবস্থান। উমার ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষকের সন্তান আফজাল হোসেন। তিনি এখন ধামইরহাট উপজেলা পৌর শহরের দক্ষিণ চকযদু টিএন্ডটি মহল্লার বাসিন্দা। একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া লাখো মুক্তি সেনাদের তিনি একজন। ৭১-এর উত্তাল মার্চের কথা। ঢাকা শহরের মতো সারা দেশেই পাক সেনাদের চলছে তাল্ডব। নওগাঁর সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলা ধামইরহাট তখন এমনই এক তা-বময় এলাকা। এলাকার মানুষগুলোর অধিকাংশই তখন সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েট আফজাল হোসেন দাঁড়িয়ে দেখছেন সে দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে যদি যেতেই হয়, তবে ফিরে আসব ট্রেনিং নিয়ে। রুখব পাক সেনাদের। কিন্তু ভাবনাটা বাস্তবে রূপ পাবার আগেই ছোট্র বাজারটাতে হানা দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। উপায়ন্তর না দেখে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দুরে আত্রাই নদীতে লুকিয়ে কাটান সারা দিন। তারপর কাউকে না জানিয়েই যুদ্ধ যাত্রা।
সংক্ষিপ্ত জীবনী ঃ আফজাল হোসেন ১৯৪৬ সালের ৯ জানুয়ারি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চকযদু (কাশিয়াডাঙ্গা) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৃত ফারাজ উদ্দিন ম-ল। আফজাল হোসেন নওগাঁর করনেশান হাইস্কুল (বর্তমানে নওগাঁ জেলা হাই স্কুল ) থেকে ১৯৬৩ সালে এসএস সি, নওগাঁর বিএমসি কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে আইএসসি এবং নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু এলাকার মানুষের সেবা করার কথা চিন্তা করে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি মাতৃভুমির স্বাধীনতার জন্যে ছুটে যান মুক্তিযুদ্ধে। তারপর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রথমে সাত নম্বর সেক্টরে। বাঙ্গালিপুর ক্যাম্পে ভর্তি হন। প্রাণের ঝুকি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইকুড়ি জেলার মুক্তিবাহিনীর সাত নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার রউফের অধীনে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে  তাকে নওগাঁর ধামইরহাট, রাঙ্গামাটি, র্ফাশিপাড়া, হিলি, চৌঘাটডাঙ্গি এলাকার পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করান। স্বাধীনতা ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি ফিরেন পরিবারের কাছে।
যেভাবে ট্রেনিং করেন তিনি : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের দিকে প্রথমে পাকিস্থানি সৈনিকের (পাজ্ঞাবি) তাড়া খেয়ে বাড়ি হতে কমপক্ষে ৫ মাইল দুরে আত্রাই নদীতে পানির নিচে মাথা বের করে ডুবে থাকেন। পরদিন বাড়ি ফিরে ধামইরহাট উপজেলার শেষ সীমানা আলতাদিঘির পূর্ব পাড়ে পালিয়ে যান। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মন স্থির করেন। তারপর ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পিতা-মাতাকে না বলে বাঙ্গালিপুর ইয়থ ক্যাম্পে ভর্তি হন। পরদিন সেখানে ভর্তি হয় আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তারা হলেন, আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অনেকেই। সেখানে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবুল আজাদ। সেখানে এক মাসের ট্রেনিং দেওয়ার পর ১০০ জনের একটি টিমকে আর্মি ভ্যানে জলপাইগুড়ি অর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানে মেজর রেড্ডীর অধীনে ট্রেনিং করেন। জলপাইগুড়ি অর্মি ক্যাম্প থেকে ১৫ দিন পর সবাইকে বিমানে করে দর্জিলিং বিমান ঘাটিতে নিয়ে যায় এবং পরের দিন উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া দেরাদুন নামক স্থানে একমাস ট্রেনিং হয় মেজর মালহুতরা ও মেজর চোয়ানের অধীনে। ট্রেনিং শেষে জলপাইগুড়ি ফিরে এসে সবাইকে একটি করে রাইফেল দেয়া হয় যুদ্ধের জন্য।
যেভাবে যুদ্ধ করেন : তার দুঃসাহসী অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে আবার তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। ফিরে যান সেই অগ্নিঝরা দিনে। একের পর এক বলে যান অগ্নিঝরা দিনের স্মৃতির গৌরবময় অধ্যায়। যা আজো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের রণাঙ্গনে। ট্রেনিং শেষে আফজাল হোসেন, আবদুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অন্তত ৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধাদের ধামইরহাট এলাকার কালুপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয় এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর চৌঘাটডাঙ্গি নামক স্থানে যুদ্ধের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আত্রাই নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে শত্রুর অবস্থানের দিকে এগোতে থাকেন। এমন সময় তাঁর মাথার উপর দিয়ে গুলি হচ্ছিল ঠিক তখন তিনি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় বাম হাতটি ভেঙে যায় এবং বাম পায়ের হাঁটুর নিচে সামান্য গুলির ছটা লাগে। এখন সেই হাতটি ভালো হলেও আজও বাঁকাই আছে এবং পায়ের গুলির দাগটি এখনও চিহ্ন বহন করে। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত ওই সময় সামনা সামনি যুদ্ধে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার প্রাণের বন্ধ লোকমানের দেহ। শহীদ হন তিনি। একই সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিকও মারা যায়। তার অল্প কিছুদিন পর দেশ স্বাধীনের আভাস শুনতে পান। তখন ছিল ১৪ ডিসেম্বর তার ২দিন পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিজয়ের কথা জানতে পারেন তিনি। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া দেয়া হয়নি কোন খেতাব। ধামইরহাটে পাক বাহিনীর দুর্গে আঘাত হানার পেছনে অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অবিস্বরণীয় ভুমিকা রেখেছেন আফজাল হোসেন। তিনি বর্তমানে নিজ বাড়িতে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন। যখনই যাকে কাছে পান তখনই বলতে থাকেন ৭১-এ ফেলে আসা সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ